নরেন ফুচকাওয়ালা

পড়াশোনায় খুব ভালো না হলেও, কথায় বার্তায় আদব কায়দায় ও চালচলনে সবার প্রিয় নরেন। স্কুলে সবাই তাকে কবি বলে ডাকত, কারণ স্কুলে ওয়াল ম্যাগ্যাজিনে সবচেয়ে ভালো কবিতাটা নরেনেরই থাকত, তাছাড়া স্কুলে স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় নরেন সব বারই প্রথম হত। ছোট থেকেই তার ইচ্ছে, একদিন সে মস্ত এক কবি হবে, বইয়ের পাতায় পাতায় থাকবে তার কবিতা। বাবা মা, স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা থেকে পাড়ার সবাই নরেনকে খুব ভালোবাসে। মানুষের বিপদে আপদে, সময়ে অসময়ে নরেন সবসময় তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করে।

3vendor
গরিব চাষির ছেলে নরেন, ইচ্ছে না থাকলে ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে উপার্জনের জন্য রাজ্যের বাইরে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিল। বাবা বলেছিল রাস্তার গায়ের ওই দশ ডেসিমেল জমিটা বিক্রি করে নাহয় নরেনকে পাশের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করে দেব। কিন্তু জমি বিক্রি করার বিষয়টি নরেন মেনে নিতে পারেনি। ওইটুকু জমিই তো সম্বল, কয়েকটি বছর পরেই বোনের বিয়ে দিতে হবে, তখন টাকা কোথা থেকে আসবে। ভাইয়ের পড়াশোনা আছে, ভাই পড়াশোনায় খুব ভালো, তার ও তো একটা ভবিষ্যত্ রয়েছে। অনেক কথা ভেবে নরেন কিছুতেই বাবাকে জমি বিক্রি করতে দিল না। বাবামায়ের মত না থাকার সত্বেও নরেন পাড়ি দিল ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে। বাবা মাকে ছেড়ে এত দূরে নরেন এর আগে কখনও যায়নি, বাবার চোখে জল ভরে এল, মা তাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদল। নরেন একটু ও কাঁদল না। নরেনের কান্না সবাই দেখতে পায় না,- ওর কান্নায় প্লাবিত হয় বালিশ খানা, ওর কান্না দেখে শুধু রাতের তারা।
ট্রেনে বসে নরেন ডায়েরি টা বের করে লিখল, –

“তোমার আঁচল ছেড়ে দূরে চলে যেতে
মা’গো মনটা যে কাঁদে, প্রাণ নাহি চায়।
তবু মা’গো যেতে হবে সব মায়া ভুলে,
গরিব খোকার বলো কি আছে উপায়!
চিন্তাটি করো না মা খোকার তরে,
তোমার খোকা যে আজ বড় হয়ে গেছে।
হাসি ভারা মুখে তুমি দাও গো বিদায়,
কষ্ট পেয়ো না মা’গো, কেঁদো না’কো মিছে।
থাকব হৃদয় মাঝে তোমারই মধ্যে
তুমি ও তেমনই ভাবে রবে আমাতে।
একদিন আমাদের ও আসবে সুদিন
কাটিয়ে আঁধার আলো আনবো প্রভাতে।”

দুই রাত এক দিন ট্রেন যাত্রার পর গন্তব্যে পৌঁছাল নরেন। শুনেছি ওখানে দিন মজুরি করে উপার্জন করার পন্থা অনেক রয়েছে। সাউথ সিটি নামক একটি যায়গায় L&T Company এর একটি প্রোজেক্ট চলছিল, নরেন তা অনিলের কাছে শুনেছে। ওখানে বাংলা চলে না, চলে ক্যানাডা ইংরেজি ও হিন্দি, অল্প বিস্তর হিন্দি কথা বলতে ও বুঝতে পারে নরেন, তাই জিজ্ঞাসা করে করে ওখানে পৌঁছাল। দেখল বেশ উঁচু উঁচু বাড়ি তৈরি হচ্ছিল ওখানে, এত উঁচু বাড়ি নরেন আগে কখনও দেখেনি, তাই যায়গাটি খুব পছন্দ হল নরেনের। অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখল ওখানে রাজমিস্ত্রির হেল্পার চাই, দিনের শেষে একশো কুড়ি টাকা মজুরি দেবে, আর অধিক সময় কাজ করতে পারলে ওভার টাইমের জন্য আলাদা টাকা আছে। খেতে দেবে না, কিন্তু থাকার জন্য একটা ঘর দেবে। নরেন হিসেব করে দেখল, ওভার টাইম কাজ করে মাসের শেষে মোটামুটি হাজার ছয়েক টাকা ইনকাম করা যাবে। হাজার বারোশো টাকায় এক মাসের খাওয়া দাওয়া ও হয়ে যাবে। তাই দেরি না করে সেদিনই নরেন কাজের জন্য দরখাস্ত করল।
ঠিকেদার নরেনকে থাকার যায়গা দেখতে নিয়ে গেল। বেশ বড় একটা এলাকা উঁচু প্রাচীরে ঘেরা, তার মধ্যে ঠিক তাঁবু আকারের ছোট ছোট ঘর সংখ্যায় প্রায় দু-শ মতো হবে। ঘর গুলো খুব ছোট্ট, কোনও রকম রাতে মাথা গোঁজার মতো আর কি! অপরিষ্কার এলাকা। সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন ধরনের মানুষ সেখানে থাকে, খুবই হট্টগোল হৈচৈ হয়। প্রথম প্রথম নরেনের খুব অসুবিধা হল, মনে করল যে, তার দ্বারা বোধহয় এখানে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু ধীরে ধীরে তা অভ্যেসে পরিনত হয়ে গেল।
মন দিয়ে কাজ করতে লাগল নরেন, সেখানে তার বয়সী দুটি ছেলের সঙ্গে তার খুব বন্ধুত্ব হল, একজন ত্রিপুরার অন্য জন পাঞ্জাবের। দুঃখ কষ্ট লুকিয়ে একই ভাবে ছয় মাস কাজ করল নরেন। সব মিলিয়ে প্রায় তিরিশ হাজার মতো টাকা ইনকাম করে ফেলল সে। বলতে বলতে দুর্গা পুজো এসে গেল। বাড়ি থেকে বাবা মা ও বাড়ি ফিরে আসার জন্য জারিজুরি করল। নরেনের মা খুব কান্না কাটি করল, কতদিন দেখেনি ছেলেকে। তাই নরেন ছুটির জন্য দরখাস্ত করল, কিন্তু ঠিকেদার বলল যে, কালীপুজোর আগে তাকে ছুটি দেবে না, এমনিতেই কাজের লোকের খুব অভাব। এদিকে রোজ ফোন করে মা খুব কান্না কাটি শুরু করল, নরেন ও মনে মনে খুব কাঁদত, সে ও তো এতদিন মাকে ছেড়ে থাকেনি কোথাও। তাই সে ছুটির অপেক্ষায় না থেকে মাসের পুরো বেতন না নিয়ে মিথ্যে বলে  ঠিকাদারের কাছে অগ্রিম কিছু টাকা নিয়ে, বাকি হাজার দুয়েক টাকা ছেড়ে লুকিয়ে পালিয়ে এল বাড়িতে। নরেন যেন কত যুগ পর পাথুরে কঙ্কাল সার শহর ছেড়ে গ্রামের কোমল স্পর্শ পেল,-

“কোথায় সবুজ তরুলতার সাজ,
যেথায় মাঠে চাষিরা করে কাজ,
হাওয়া যেথা দোলায় গোটা গ্রাম,
দুলতে থাকে হলুদ পাকা আম,
কোথাও দোলে কাজল কালো জাম,
এই আমাদের ছোট্ট পল্লী গ্রাম।
যেথায় মাঠে ফলে সোনার ধান,
বাঁচায় সরল গ্রামবাসীদের প্রাণ,
যেথায় মাঠে রাখাল চরায় গরু,
যেথায় শুধু সবুজ সবুজ তরু,
অন্য ভাষা ফেলে দিয়ে দুরে,
কথায়, গানে, ছন্দ আর সুরে,
ছড়ায় যেথা পল্লীগীতির নাম,
সে যে আমাদের ছোট্ট পল্লী গ্রাম।
বহু পুরনো ছোট্ট পল্লী গ্রাম।”

এক মাস বাড়িতে থেকে আবার ওখানে ফিরে গলে সে, কিন্তু ঠিকেদার আর তাকে কাজে নিল না, তার বেতনের বাকি টাকাও আর দিল না। সেটাই স্বাভাবিক কারণ নরেন ও ছুটি মঞ্জুর হওয়ার আগে লুকিয়ে পালিয়ে অন্যায় করেছে। তাই বেশি জারিজুরি না করে, সে হেমন্তদাকে ফোন লাগাল। হেমন্ত দা গুজরাতে রিলায়েন্স কম্পানিতে স্কেফোল্ডার বিভাগে সুপার ভাইজারের কাজ করেন, সেখানে নিশ্চয়ই কোনও কাজ মিলবে। হেমন্ত দা নরেনকে খুব স্নেহ করেন, তাই না বললেন না, তিনি নরেনকে ব্যাঙ্গালোর থেকে গুজরাত যাওয়ার ট্রেন পথ বুঝিয়ে দিলেন। সেই মতো নরেন প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা ট্রেন যাত্রার করে, গুজরাতের “ভুরুচ” নামক একটি রেলওয়ে স্টেশেনে নামল, সেখান থেকে বাসে করে পৌঁছাল “দেহেজ” গ্রামে। আরব সাগরের তীরে অবস্থিত এই গ্রামটি। সু-বিশাল এলাকা জুড়ে সেখানে গড়ে উঠেছে একটি অত্যাধুনিক রিফাইনারি ফ্যাক্টিরি।
পৌঁছে হেমন্ত দাকে ফোন করা মাত্রই একটি মারুতি গাড়ি এসে তাকে নিয়ে গেল একটি কলোনিতে, যায়গাটির নাম ‘জোগেশ্বর’ খুব সুন্দর যায়গা, বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের সাথে চোখাচোখি হয়। কলোনির সামনে প্রায় তিন থেকে চারশো মিটার বিস্তৃত একটি ঘাসজমি পেরোলেই সমুদ্রতটে পৌঁছানো যায়। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপূর্ণ যায়গা। নরেনের খুব ভালো লাগলো যায়গাটি।

“আমি সুবর্ণরেখা, বঙ্গোপসাগর ছাড়ি
আজ আমি আসিয়াছি তোমার স্মরণে।
নাও’গো আপন করি, ওহে আরব সাগর
লুটাইবো সব প্রীতি তোমারই চরণে।”

স্নান করে হোটেলে গিয়ে ভাতের খোঁজ করে না পেয়ে রুটি খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিল নরেন। গত চার পাঁচ দিন, ঘুম হয়নি বললেই চলে। সন্ধ্যায় হেমন্ত দা এল, এবং জানিয়ে গেল কাল সকালেই কম্পানিতে গেটপাসের জন্য যেতে হবে, সেখানে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষায় পাস করতে হবে তাকে, তারপর কাজ মিলবে। ফ্যাক্টিরির মধ্যে চারিদিকে বিপদ আর বিপদ, রাসায়নিক দ্রব্যে ভরা, ভয়ঙ্কর অ্যাসিড ও গ্যাসে ভরপুর সার এলাকা। পরীক্ষা নেবে, তার সাধারণ জ্ঞানের, আইডেনটিটি কার্ড ঠিকঠাক হওয়া চাই, এবং মেডিক্যাল চেক আপ ও হবে, তার জন্য প্রস্তুতি নিল সে। রেফাইনারি ফ্যাক্টিরি বিষয়ক একটি বই দিয়ে গেলেন হেমন্তদা, বাংলায় লেখা, নরেন তা পড়ে অনেকটা ধারণা করল। পরদিন সকালে নরেন কম্পানি অফিসে গেল, এবং সব পরীক্ষায় সফল হল সে, গেটপাস পেয়ে গেল একদিন পর। মাসের শেষে পুরো বারো হাজার টাকা দেবে কোম্পানি, নরেন দারুণ খুশি। এতগুলো টাকা এক মাসে ইনকাম করা যায় নরেন ভাবতেই পারেনি। সে হেমন্তদাকে জড়িয়ে একটা চুমু খেল।
তারপর কাজে জয়েন করতে গিয়ে বুঝল, টাকা বেশি হলে কি হবে, কাজটা ও খুব কঠিন। জীবনের বাজি লাগিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে পঞ্চাশ থেকে ষাট মিটার উপরে ঝুলে ঝুলে কাজ করতে হবে।
স্কেফোল্ডিং অর্থাৎ লোহার পাইপে ক্ল্যাম লাগিয়ে টেম্পুরারি প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ। ঠিক যেমন বাঁশ বেঁধে বেঁধে দুর্গা পুজোর প্যান্ডেল তৈরি করে, অনেকে কাজটিকে পাইপলাইনের কাজ বলে।
এমনিতে নরেন উঁচু থেকে ভয় পায়, কিন্তু পরিবারের জন্য সব ভয় তোয়াক্কা করে নরেন সিনেমার হিরোদের মতো পঞ্চাশ মিটার উঁচুতে হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে মাসের শেষে বারো হাজার টাকা গুনতে লাগল। এভাবে চার মাস কেটে গেল। হঠাত্ একদিন তার চোখের সামনে সত্তোর মিটার উপর থেকে একজন পড়ে গেল নীচে। তার শরীটা আস্ত ছিল না, তিন টুকরো হয়ে গেছিল। সে কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার, নরেনের মনে একটি আতঙ্ক ঢুকে গেল, তারপর তিনদিন সে কাজে যায়নি, চোখ বন্ধ করলেই সেই ছবিটি ভেসে ওঠে। চতুর্থ দিনে কাজে গিয়ে ও কাজ করতে পারেনি, ভয়ে পাইপে চড়তেই পারেনি সে। বাধ্য হয়ে সাড়ে চার মাস কাজ করে সেখান থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে নরেন। এই ভাবে কাজের খোঁজে উপার্জনের জন্য তিন বছর ধরে প্রায় সারা ভারতবর্ষ ঘুরে নিয়েছে নরেন, কিন্তু মন পছেন্দর কাজটি আর কোথাও পেল না সে।
অবশেষে গ্রামে থেকেই কিছু করার ইচ্ছে গড়ল মনে। ছোটখাটো কোনো চাকরি পাওয়ার অনেক চেষ্টা করল, পোস্ট অফিসে কিংবা ব্যাঙ্কে, কিন্তু অনেক টাকা ঘুষ চাইল সেখানে, তাই হল না চাকরি করা।শেষে ছোট বাচ্চাদের টিউশন পড়িয়ে কিছু টাকা ইনকাম করার চেষ্টা করল, এভাবে চলল কিছু দিন।
একদা কারো উৎসাহে নরেন আবার পড়াশোনা করার কথা ভাবল, একটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করল নরেন। এদিকে তার স্বপ্নে রঙ দিতে না দিতেই ছোট্ট ভাই ও বোনের স্বপ্নের রঙ ফ্যাকাশে হতে লাগলো। নরেন বুঝে গেল, স্বপ্ন তো অনেক কিন্তু সে স্বপ্নে রঙ দেওয়ার মতো রঙ নেই তার রঙ বাক্সে। তাই সে নিজের স্বপ্নগুলোকে গলা টিপে খুন করতে বাধ্য হল। টিউশন পড়িয়ে ও সামান্য কটি টাকা ইনকাম করা যায়, তা দিয়ে চলে না আর।
নরেন ইলেকট্রিক ও মাল্টিমিডিয়ার দিকে অনেকটা আগ্রহী ও দক্ষ, তাই ভাবল গ্রামে ইলেকট্রনিকের একটি দোকান গড়বে, কিন্তু তাতে তো অনেক টাকার দরকার, কোথায় পাবে এত টাকা। তাই সেটাও তার হল না। অবশেষে পাড়ারই নীতিন দার পরামর্শে নরেন এখন ফুচকা বিক্রি করে। দিনের শেষে গড়ে তিনশো টাকা ইনকাম হয়। বাজারে নরেন এখন খুব পরিচিত, তার ফুচকা এখানকার বিখ্যাত। সবাই তাকে এক ডাকে চেনে,- “নরেন ফুচকা ওয়ালা”।
দিনের শেষে মায়ের শীতল আঁচল তলে নরেন আজ মুগ্ধতা বোনে স্নিগ্ধতার সহিত। আজ নরেন হয়তো এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো ছেলে, খুব ভালো দাদা, দারুণ সুখী মানুষ।

Avatar

Surajit Shee

আমি সুরজিৎ সী, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি অত্যন্ত ছোট্ট অখ্যাত গ্রামে থাকি।

More Posts

Related posts

Leave a Comment