বড্ড দেরী হয়ে গেছে আজ, পাক্কা এগারোটায় S.M.-এর ক্লাস। ঠিক সময়ে পৌঁছতে না পারলে ম্যাম দেবেন একখান মোক্ষম প্র্যাকটিকাল ওয়র্ক।তারপরে না পারলে সোজা ক্লাসের বাইরে।হ্যাঁ,ঠিক স্কুলের মতো।স্কুলের থেকেও যেন এখানে বেশী ভয় লাগে সবার।
তারপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা একটাও রিকশা,টোটো বা অটো কিছুই যাচ্ছে না এদিক দিয়ে।
কোনোরকমে একটা রিকশা পেয়েই তাতে চটপট উঠে বসলো বাবনু।বাবনু জুলজি অনার্স নিয়ে সেকেন্ড ইয়ারে উঠলো এইবারে।
বাবনু রিকশায় ওঠবার আগেই একটি মাঝবয়সী ভদ্রলোক আগে থেকেই রিকশায় বসেছিলেন। বাবনু তাড়াহুড়োতে ব্যাগ থেকে ৫ টাকার খুচরো বের করতে যাচ্ছিলো। মাঝবয়সী ভদ্রলোকটি বাবনুকে বললেন যে ও যেন ওঁর সাথে খুচরোগুলো এক্সচেঞ্জ করে নেন আর তার বদলে উনি ওঁর দশটাকার নোটটা ওকে দেবেন কারন ওঁর কাছে পাঁচটাকার খুচরো ছিলোনা, এদিকে দুজনের ভাড়া একই।কারন দুজনেই প্রায় একজায়গায় নামে। এরকম হামেশাই হয়ে থাকে।কারো কাছে খুচরো না থাকলে সে কোপ্যাসেঞ্জারের কাছ থেকে খুচরো নিয়ে আর নোট দিয়ে এক্সচেঞ্জ করে নেয়।
কিন্তু আজ তার ব্যাতিক্রম ঘটলো। বাবনু দেখলো কলেজমোড়েই নেমে গেলো লোকটা,দুজনের ভাড়া মিটিয়ে। আর কিছুটা গেলেই বাবনুর কলেজ এসে যাবে। কলেজের সামনের রাস্তাটা অনেকটা ঢালু। তাই উঠতে বেজায় কষ্ট হয়। সেজন্য অনেক রিকশাওয়ালা ঢালুর ঠিক নীচের রাস্তায় একটা জুসদোকানের সামনেটায় নামিয়ে দেয়।সেখান থেকে উঠে কিছুটা হাঁটলেই কলেগের গেট।
কিন্তু আজ বাবনুর কপালটা ভালোই বলতে হয়। রিকশাকাকুটা এক্কেবারে কলেজের সামনে এনে নামালো। বাবনু গদগদ চিত্তে যেই না কলেজের গেটের ভেতরে ঢুকতে যাবে অমনি পেছন থেকে একটা ক্লান্ত গলা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে বলে উঠলো- ” বাবু পইসাটো দিবেনি?”
বাবনু পেছন ফিরে তাকালো। বাইরে তখন রোদে ঝাঁ ঝাঁ করছে গোটা রাস্তাটা।সেই রোদেতে রিকশাকাকুর মুখটা ঘেমে নেয়ে চকচক করছে। বাবনু বললো,”কেন? আরেকজন যে বসেছিলো সে দেয়নি? ওঁর কাছে তো খুচরো ছিলোনা,তাই আমার কাছ থেকে পাঁচটাকার খুচরো নিয়ে একটা দশটাকার নোট দিলেন।আমি তো ভাবলাম উনি আমার ভাড়াটাও মিটিয়ে দিয়েছেন।”
রিকশাকাকু বললো- “কই নাতো।উনি তো নিজের ভাগের ভাড়াটা দিয়েই নেমে গেলেন।”
বাবনু কিছু না ভেবেই ব্যাগ থেকে ওই দশটাকার নোটটাই বের করে রিকশাওয়ালা কে দিলো।
রিকশাকাকু নোটটা দেখে বললো-” বাবু আমরা খেটে খাওয়া মানুষ।সারাদিন রিক্সা চালিয়ে যা পাই তাই দিয়ে দিন গুজরান করি।এই টাকা দিয়েই মেয়েটাকে গ্রামের একটা কোলেজে পড়াইছি।সে তো জানে তার এই বাপটার দুখের কথা,তাই কোলেজ থেকে ফিরেই দু-দুটা বাস্সা পড়ায়।সারাদিন খুব খাটে।তুমিও নিসচি খুব খাটো।এই টাকাটা বাঁসিয়ে রাখো।খিদে পেলে টিফিন খাবে বাবু।”
বাবনু এইসব কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো,তার মাথায় তখন আর S.M.-এর ক্লাস,প্র্যাক্টিকাল কিছুই নেই।সে শুধু দেখতে পাচ্ছে একটা লোক তার সওয়ারি নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে, তার সারা শরীর থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে একটা অদ্ভুত আলো।যে আলোয় জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত স্বার্থপর, কূট, খারাপ অমনুষ্যত্ব। এভাবেই বাবনু আর তার রিকশাকাকুর মধ্যে সৃষ্টি হলো এক মানবিক সম্পর্কের,যার সাক্ষী থাকলো কেবল ওই ঢালু রাস্তাটা।