…আপন রাগে, গোপন রাগে, তরুন হাসির অরুন রাগে, অশ্রু জলের করুণ রাগে রাঙিয়ে দেবার মহোৎসব হল “হোলি” ।
ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে আকাশের চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে হোলির আগমনে। দেশের সর্বত্র বিভিন্ন নামে হোলি উৎসব পালন করা হলেও, সব মানুষের মধ্যে হোলির রঙিন আবেগের এক বিরল সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। শুধু দেশ কেন, বিদেশেও যখন হোলি খেলা হয়, সেই একই উন্মাদনা লোকমানসে বিরাজ করে।
সবার মনের সাথে হোলির আগমনী বার্তা ছড়িয়ে পড়ে রাস্তা ঘাটে, অলিতে গলিতে – রংবেরঙের আবীরের স্তুপে। কত রকমের পিচকারি, মুখোশ , টুপি – ছোটদের নিয়ে তো সেই সময় বাড়ির বাইরে বেরনোই এক সমস্যা; কিন্তু, আমদের ছোটবেলাকে মনে করলেই, ওদের রঙ খেলার উত্তেজনাকে বোধ করা যায়, তাই না?
মহিলারা হেঁসেলে হোলির আনন্দ কে ছড়িয়ে দেয় মাঠরি, পাপড়ি তৈরির আয়োজনে । হরেক রকম মিষ্টির পসরা নিয়ে বসে দোকানগুলি।
শীতের রুক্ষতার অবসানে বসন্তের সুচনা হয় হোলির মাধ্যমে – তাই হোলির অপর নাম “বসন্ত উৎসব”। আকাশে বাতাসে এই সময় এক অদ্ভুত মাদকতা। সবুজ পাতায় আগুন লাগায় পলাশ – কৃষ্ণচূড়া, শীত চলে যাবার রেশ নিয়ে এক মোলায়েম ঠাণ্ডা বাতাস শরীর মন স্নিগ্ধ করে। উর্বর জমি নতুন ফসল প্রসব করে, গ্রামীন প্রকৃতি মনখোলা হাসিতে প্রজ্বলিত হয়।
হোলি বিশেষতঃ একটি হিন্দু উৎসব হলেও, জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে পালিত হয় – বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষে এক দুর্নিবার ঐক্য প্রকাশিত হয়।
বিভিন্ন স্থানে হোলি উৎসব পালনের উৎস হিসেবে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি বর্ণিত আছে।
রাজা হিরণ্যকশিপু নিজের রাজ্যে সবাইকে বাধ্য করত তার আরাধনা করার জন্য। হিরণ্যকশিপুর আপন সন্তান প্রহ্লাদ ছিল ভগবান বিষ্ণুর অন্ধ ভক্ত। হিরণ্যকশিপুর বন হোলিকা বর পেয়েছিল অগ্নিভস্ম না হওয়ার। হিরণ্যকশিপু বিষ্ণুর দৈবশক্তিকে আহ্বান করে হোলিকা কে আদেশ দেয় প্রহ্লাদ কে কলে নিয়ে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করার … কিন্তু হায়, হোলিকা বর পেয়েছিল যে সে কখনো অগ্নিভস্ম হবে না – সে যাত্রায় হোলিকার মৃত্যু হয় এবং ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদধন্য প্রহ্লাদ অক্ষত শরীরে অগ্নিকুণ্ড থেকে বেরিয়ে আসে। ভগবান বিষ্ণুর জয় চিন্হিত করার জন্য হোলির আগের দিন হোলিকার কুশপুতুল দাহ করা হয় – বিশেষতঃ গুজরাট ও ওড়িশ্যায় এটি “ছোটি হোলি” হিসেবে পরিচিত। কুশপুতুল দাহের সাথে সাথে অগ্নিদেবের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শস্য – ফলমূলের আহূতি দেওয়া হয়। হোলিকা দহনের ভস্ম ও পবিত্র হিসেবে মান্য করা হয় – মানুষ কপালে সেই ভস্ম লেপন করে নিজেকে যাবতীয় বিপদ থেকে সুরক্ষিত মনে করে।
কংসের বোন রাক্ষসী পুতনা একবার বিষাক্ত দুধ খাইয়ে শিশু কৃষ্ণ কে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু, পরিণতিতে , শিশু কৃষ্ণের দৈব ক্ষমতায় পুতনার মৃত্যু হয়। বহুস্থানে, শীতের অবসান ও বসন্তের আগমন কে যথাক্রমে রাক্ষসী পুতনার মৃত্যু এবং শ্রীকৃষ্ণের বিজয় রুপে চিন্হিত করে হোলি পালন করা হয়।
আরেকটি গল্প আছে। পৃথুর রাজ্যকালে, ‘ধুন্দি’ নামে এক রাক্ষসী ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভীষণ বিরক্ত করত। একবার দল বেঁধে ছোটরা সেই রাক্ষসীকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেয়। সেই জয় পালন হেতু হোলি উৎসব এবং সেজন্যই হোলির সময় ছোটদের দুষ্টুমিটা গ্রহণযোগ্য ।
দক্ষিন ভারতে, আরাধ্য দেবতা কামদেব হলেন অপর্যাপ্ত প্রেম, আবেগ ও আত্মত্যাগের প্রতীক। কথিত আছে, ভগবান শিব যখন ধ্যানমগ্ন ছিলেন, পার্থিব সুখের প্রতি মহাদেব কে আকৃষ্ট করার জন্য তাকে প্রেমবানে বিদ্ধ করেছিলেন। রুষ্ট মহাদেব এই অপরাধ হেতু তৃতীয় নয়ন দিয়ে অগ্নিবর্ষণ করে কামদেব কে ভস্মে পরিনত করেন। শেষে, কামদেবের স্ত্রী রতি র অনুনয় অনুরোধে মহাদেব পুনরায় কামদেব কে ফিরিয়ে আনেন। ভালবাসার বিজয় চিন্হিত করতে এই প্রথায় হোলি পালিত হয়।
হোলির দিন ঢাক–ঢোল-গান–বাজনা সহযোগে মহাসমারোহে একে অপরকে রঙ লাগায়। হোলি উৎসব ভালবাসার উৎসব, প্রেমের উৎসব। শ্রীকৃষ্ণ হলিতে শ্রীরাধাকে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন ভালবাসার রঙে । দুটি মনের মিলন কে স্বীকৃতি দিতে সেই পরম্পরা আজ চলে আসছে।
হোলিতে রঙ লাগানোর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ‘ভাঙ’- এক উত্তেজক পানীয়, যা মিশে যায় হোলির আবেগের সাথে।রঙ খেলার শেষে রেওয়াজ হল, গুরুজনদের প্রণাম ও আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি গিয়ে মিষ্টিমুখ ।
মনে করা হয়, হোলিতে শত্রুরাও বন্ধু হয়ে ওঠে। সর্ব জাতিধর্মবর্ণের এইরকম এক ভাবে স্যোৎসাহে উদযাপন করা একমাত্র উৎসব হল হোলি।