আপনাদের কার কার গরম খাওয়ার বাতিক আছে শুনি? না, ঠান্ডা করকরে ভাত, কি নেতিয়ে চিমসে যাওয়া টোস্ট খেতে মোটেই বলছি নে, ও আবার কারো ভাল্লাগে না কি? কিন্তু এমন অনেকেই আছেন না, যাঁদের খাদ্য বা পানীয়, বাঞ্ছিত উষ্ণতার থেকে সামান্য, অতি সামান্য, রতি মাত্র কমে গেলেই মুখ ভার, কান কটকট, পেটে ডিফার্যানশ্যাল ক্যালকুলাস ইত্যাদি হয়?এঁরা মহান লোক মশাই।এঁরা অক্লেশে আগুন-গরম ফিশফ্রাই তে প্যাকম্যানের মত হাঁ করে কামড় বসান, ফুটন্ত স্যুপ সুড়ুৎ করে গলা দিয়ে গলিয়ে ফেলেন, কড়াই থেকে সটাং পাতে আসা ফুলকো লুচিকে ফুস্করে দিতে গিয়ে এঁদের চম্পকাঙ্গুলিতে একটুও ফোস্কা পড়েনা, আর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিভে ছ্যাঁকা না খেলে তো এঁদের মৌতাতই হয় না!
এই আগুনখেকোদের আমি নেহাত ডরাই।আমি শুধু যে এঁদের ধারে কাছে নই তা নয়, আমি একদম উলটো ধাতের।
আমি না, মোট্টে গরম কিছু খেতে পারি নে।ও রকম ভয়ানক গরম তো কোন ছাড়, সাধারণ লোকে যেমন গরম দিব্যি খেয়ে নেয় আমি সেটাও, হেঁ হেঁ, খেতে বললে কাতর হয়ে পড়ি।
সেই যে সত্যজিৎ রায় জীবনে প্রথম বার আইসক্রিম খেয়ে দাঁত সুড়সুড় করায় বলেছিলেন আইসক্রিমটা একটু গরম করে দিতে? আমিও তেমনি হাতে গরম আলুর চপ কি ধূম্রলোচন কফি খেতে হলে, আগে একটু ঠান্ডা করতে দিই।
তারপর অবধারিত ভুলে যাই।
ভুলে যাওয়ার আবার রকমফের হয়। মাঝে মধ্যেই এরকম রেখে তারপর কোথায় রেখেছি ভুলে যাই।এরকম হলে তবু রক্ষে। অন্য কেউ টের পাবার আগেই সম্ভাব্য সব অকুস্থল খানাতল্লাশি করে আসামী হাজির করে ফেলার একটা নাতিক্ষীণ সম্ভাবনা তবু থাকে এক্ষেত্রে। নেহাৎ যদি না আমার অতি সতর্ক পিতৃদেব বা মমতাময়ী কর্মসহায়িকা ‘আহা ঠান্ডা হয়ে যাবে’ বলে সেটা আবার রন্ধন কক্ষের উষ্ণতায় সরিয়ে রেখে থাকে।এসব উষ্ণতা পিয়াসীদের আমি বলে বলে বুঝিয়ে উঠতে পারি না যে ঠান্ডা করাটাই আমার অভিপ্রায় ছিল।অমন তেজস্বী জিনিসপত্র আত্মস্থ করব এমন জোর আমার নাজুক কণ্ঠের নেই! তেমন ভাবলেও ভয়ে ভ্যাবলা হয়ে ভাবালু হয়ে পড়ি আর কি!
তবে, তাদেরও একে বারে পুরো দোষ দেওয়া যায় না অবিশ্যি।বেশির ভাগ সময়ই আমি সেই ধূমায়িত চায়ের কাপ, কি উচ্ছল উত্তপ্ত চাউমিনের বাটি, কি অগ্নিগর্ভ মাছের চপের প্লেটের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই সম্পূর্ণ বিস্মরণ হয়ে পড়ি কি না! হয়তো একঘন্টা তেরো মিনিট সাতাশ সেকেন্ড পরে আমার মাতৃদেবী সেটা কে খাবার টেবিলের ওপর আবিষ্কার করেন। ততক্ষণে সে বস্তুটি পান্তাশীতল হয়ে খাদ্য-অযোগ্য হয়ে গেছে।আশ্চর্যের বিষয় হল, তার পরবর্তী কিছুক্ষণ, মানে মা, তার পোঁধরে মেয়ে, এবং তাদের ধামাধরা কাজের দিদির বাক্যালাপ শেষ না হওয়া অবধি আমি না কানে কিচ্ছু শুনতে পাই না মশাই, এমন কি আপনি ফিসফিস করে প্রেম নিবেদন করে গেলেও শুনতে পাব না।
তারপর, সেই অবহেলিত নিপীড়িত নির্যাতিত বস্তুটি ঘোর প্রতিহিংসা স্বরূপ আমার কাছে ফিরে আসে, আগের চেয়েও বেশি তাপমাত্রায় গরম হয়ে। সুতরাং, বাধ্য হয়েই, প্রাণরক্ষার খাতিরে আমায় আবার সেটা ঠান্ডা করতে দিতে হয়।
এই লুপ চলতেই থাকে।
এই গরম ঠান্ডা নিয়ে আরেকটা বিরাট ফ্যাচাং ছিল আমার আপিশে। ছিল মানে এখনো আছে, ফ্যাচাং জিনিসটা মোটেও স্বল্পায়ু বা দুর্বল নয়, কিন্তু অনেক দিনের তন্নিষ্ঠ গবেষণার পর আপাতত আমি সেই দুরূহ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বার করেছি।
সঠিক উত্তর হল ৫৭:৪৩।
বোঝেন নি তো? সবুর, মেওয়া না হোক মোয়া জুটবে।
অফিসের ব্রেক আউট রুমে, খাবার জলের ইউনিটটার দুটো কল। তাদের টেম্পারেচার সেট করা আছে কোন এক গূঢ় সূত্র অনুযায়ী, আমার মত মূঢ় লোকেরা তার হদিশ পায় না।ফলে সকলেই হয় প্রায়-ফুটন্ত জলে টাগরা পুড়িয়ে ফ্যালে, নয় বরফ গলা বারিধারায় গলা ধরিয়ে ফ্যাশফ্যাশে সুরে কথা কয়। একবার এক অতি সুদর্শন সুবেশ মৃদুভাষ যুবককে রেগেমেগে লাথি কষিয়ে দিতেও দেখেছি। বেচারা তিন বার চেষ্টা করেছিল, প্রথমবার অতি গরমজল পেয়েছিল, পরেরবার অতি ঠান্ডা, শেষবার অতিরিক্ত – মানে বোতল উপচে জল পড়ে জামার হাতা ভিজে গেছিল।
তো গত একমাস ধরে, রিসার্চ করছিলুম ঠিক কি অনুপাতে এই দুই তরলকে মিক্স করলে সাধারণ উষ্ণতার, যাকে বলে রুমটেম্পারেচারের জল পাওয়া যাবে। তারই ফল ঐ।৫৭:৪৩। ৫৭% গরম জল, ৪৩% ঠান্ডা জল।
মুশকিল হচ্ছে, রোজরোজ তো ওই ঘাড় বেঁকিয়ে বোতলের মধ্যে চোখ চালিয়ে মাপা পোষাতা নেহি।এদিকে প্লাস্টিকের স্বচ্ছ বোতলও চলবে না, যা গরমজল বেরোয়, ফ্রী তে ডিজাইনার শেপ হয়ে যাবে।সব চেনাজানা দোকান ঘোরার পর গাইতেই হচ্ছে ‘এমন একটা বোতল খুঁজে পেলাম না…’
বোতল বলতে আরো গল্প মনে পড়ে গেল।হয়েছে কি, প্লাস্টিক বোতল তো কবেই ত্যাগ করেছি, ঘরে শুধু কাচ হি কাচ।রাশি, রাশি, থরে থরে ড্রিঙ্কসের সুপুষ্ট বোতল, চৌকশ, সুন্দর নীল ঢাকনি দেওয়া।সব চেয়েচিন্তে জোগাড় করা, মোটেও আমি অমন ইয়ে নই, আপনারাও না…বোতল শুনেই মুখখানা হাসি হাসি করে ফেললেন তো? যত্তসব!
তো আমাদের তো দেখে দেখে এবং ঐ বোতল থেকে খেয়ে খেয়ে চোখ সয়ে গেছে।নতুন করে মনে পড়ে ঘরে কোন অতিথি এলে।ফলে ভ্যাবাচ্যাকা কলেজেরব ন্ধু, ভয়ে শিঁটিয়ে যাওয়া পড়শীর-প্রথমবার-আসা-মা, উল্লাসে ডগমগ চোখ তরুণ ক্যানভাসার, সন্দিগ্ধ প্লাম্বার – সবাইকে আমি নির্বিকার নির্বোধচিত্তে জিন অ্যান্ড লাইমের বোতল থেকে নিরীহ জল পরিবেশন করতে থাকি।তারপর তাদের মুখ দেখে, স্বভাবসিদ্ধ হড়বড় করে ব্যাখ্যা দিতে যাই কেন কাচের বোতল ভাল, তারপর নিজে খেয়ে দেখাই যে ওটা প্লেন জল মাত্র, তারপরও দরকার হলে অ্যাকোয়াগার্ড চালিয়ে ফ্রেশ জল ভরে দিই গ্লাসে।পড়শীর মা কে দিতে হয়েছিল।সে মহিলা এখনো এখানে এলে, রাস্তায় দেখাটেখা হলে, আমার দিকে ঘোর সন্দেহের চোখে তাকান।
আরো একজনকে ভরে দিতে হয়েছিল, নতুন কাজে জয়েন করা টিকিওলা কুরিয়ার বয়টি কে – বেচারা প্রায় কেঁদে ফেলেছিল কি না “হাম নেহি পীতে ম্যাডামজী!!!” বলে।
যাক, সে তো না হয় হল। বোতল আপাতত তাকে তুলে রেখে যা বলছিলুম তাতে ফিরে যাই।ওই যে, মোট্টে গরম কিছু খেতে পারি না? এইমাত্তর সে বাবদ এক কীর্তি করে ফেললুম।
আচ্ছা, আপনারাই বিচার করুন।কফি বানালুম।তুমুল গরম মনে হল।ঠান্ডা করতে দিলুম।এই অবধি একদম রানাঘাট টু তিব্বতের মত সোজা স্মৃতিরসরণী।তারপর কি যেন হল, গোটা দুই বাগবাবাজীর পিন্ডি চটকে, নেক্সট আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে খেয়াল হল কফিটা খাইনি তো! কিন্তু সেটা গেল কই? আশপাশ, কম্পির পিছন, পাশের মহিলার ব্যাগের আড়ালে কোথথাও পেলুম না, মানে ব্রেকআউট রুমেই ফেলে এসেছি আর কি।
যা ভেবেছি তাই, ঢুকেই দেখি মেশিনের পাশে মরাল শুভ্র কাপ শোভা পাচ্ছে।তুলে এনে চেয়ারে গুছিয়ে বসে দেখি সে ব্যাটা তখনো ধোঁয়া ছাড়ছে! বুঝতেই পারছেন সেটা আবার ঠান্ডা করতে দিতে হল।
তারপর বসে বসে ভাবছি কোম্পানি কি ভাল কাপ দেয়, এতক্ষণ ধরে উষ্ণতা সংরক্ষণ, ভাবা যায়…আমার সপ্রেমী সদাহাস্যময় বসের আবির্ভাব, তাঁরও হাতে কফির কাপ।
কফি ব্রেক নিয়েছিস নে না! আমার সাথে এসে না হ্যাজালেই নয়? তাও এমন বেয়াড়া মন্তব্য সহ? আমাতুল্য চমকপ্রদ মনুষ্য তিনি না কি কদাপি দেখেন নি, ইহ জীবনে দেখার আশাও বাতুলতা মনে করেন!
না হয় নিজেরটার বদলে তেনার গত দেড় মিনিট ধরে অদ্ভুত কৌশলে নিজস্ব অ্যালগোরিদমে বানানো কফিটা নিয়ে এসেছিলুম, না হয় সেটা কোথায় ঠান্ডা করতে রেখেছি মনে করতে আরো এক মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড সময় নিয়েছি, না হয় সেটা সামনের রোয়ে এই ভদ্রলোকের নিজের ডেস্ক থেকেই উদ্ধার হয়েছে, তাবলে এমন কথা? কি অসব্বো বলুন দিকি! নেহাত আমি মাথা গরম করি না, নইলে ‘তেড়ে মেড়ে ডান্ডা করে দেব ঠান্ডা’ হয়ে যেত, হুঁঃ!