গভীর অন্ধকারে, যখন সবাই ঘুমের দেশে, তখন, ছোট ছোট শহরের মত, রাতের আকাশের তারার মত, জ্বলতে থাকে ইস্পাত নগরী দূর্গাপুরের কারখানার আলোগুলি। ঠিক যেন মনে হয়, কেউ ছোট্ট শহরকে আলোয় মুড়ে রেখেছে জায়গায় জায়গায়, যেন জানাতে চায়, শিল্প নগরী ঘুমায় না।
সেভাবেই হয়তো দূর্গাপুর কে অধিকাংশই চেনে, ডাক্তার বিধান রায় এর তৈরী তিনটি স্যাটেলাইট টাউন এর মধ্যে একটি। বাকি দুটি, কল্যাণী আর খড়গপুর, শিক্ষা নগরী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মন্দার জন্য কিন্তু সে সময় দূর্গাপুর ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেকে ধীরে ধীরে শিক্ষা এবং শিল্পনগরী দুটো তেই নিজেকে প্রমাণ করে পুনরায় পুরনো জায়গায় ফিরে এসেছে এবং অন্যতম শিক্ষা গ্রহণের একটি স্থান হিসেবে নাম করে নিয়েছে। সব শহরের মতই, দূর্গাপুরের নিজের প্রাণ রয়েছে। চওড়া রাস্তা, বড় বড় গাছের সমাহারের মধ্যে নানা ধরনের টাউনশিপ এর সমষ্টি। কোনোটা ব্রিটিশদের সাহায্য নিয়ে তৈরী, তো কোনোটা রাশিয়ানদের দিয়ে হাতেখড়ি। সেসময়ে পশ্চিমবাংলার সবচেয়ে ভাল ভাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বাছা বাছা ছেলেদের নিয়ে আসা হয়েছিল। কালক্রমে তারা দূর্গাপুরেই রয়ে গেছেন, ছেলে মেয়েরা অনেকেই পরবর্তী প্রজন্ম ওখানেই বড় হয়ে সংসার করে চাকরী করে রয়ে গেছেন। সেও সত্তর বা আশির দশকে। তখন দূর্গাপুর এ নাম করা কলেজ বলতে রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, অধুনা এন আই টি,সেখানে বাইরে থেকে ছেলে মেয়েরা পড়তে আসতো, সেভাবেই কনভেন্ট স্কুল গুলিতে বাঙালী অবাঙালী বিদেশি ছাত্র বা ছাত্রী রা পড়তো। স্বাভাবিক ভাবেই, আর পাঁচটা মফস্বল বলতে যে সব শহর কে বোঝায়, দূর্গাপুর সেই ধাঁচের ছিলনা। চিরকাল ই কস্মোপলিটান কালচার। প্রতিটি টাউনশিপ প্লানড, এবং স্টাফ ক্লাব থেকে অফিসার্স ক্লাব, লাইব্রেরী, অডিটোরিয়াম থেকে সুইমিং পুল, সব ই ছিল। সব ই যখন আছে তখন কম বয়েসী দের প্রেম ভালবাসা থাকবেনা, সেও কি হয়? প্রেম আগাছার মত, যতই মহিরুহ পথ আটকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, সে বাঁচার তাগিদে একটু এক ফালি আকাশের দিকে বেগে ধাবমান হবেই এবং নির্মূল না হওয়া অব্ধি চেষ্টা চালিয়েই যাবে। তাই শহরের আনাচে কানাচে প্রেম, পড়তে যাওয়ার নাম করে প্রেম, দোকান বাজার করার নামে প্রেম, রাস্তায় বাইক নিয়ে রোজ বা সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রেম, প্রেমের চরিত্র তার পিতৃ দেব ও পাল্টাতে পারবেন না। কোনো পাড়ার দীপা বেপাড়ার ছেলের সাথে ঘুরে বেড়ায়, সে জন্য পাড়ার ছেলেদের আফসোস আর রাগ থাকাটা স্বাভাবিক। দূর্গাপুর এ প্রেম করার জায়গা বলতে ব্যারাজ বা কুমারমংগলম পার্ক। পাড়ার মধ্যে প্রেম করে বেড়ানো সম্ভব না। আবার সব সময় ব্যারাজ বা পার্ক যাওয়াও না। পার্ক যদিও ছোট বড় সব টাউনশিপেই আছে, তবুও সবচেয়ে বড় কুমারমংগলম। বাজনার তালে তালে ফোয়ারার ছটা, আর চারিদিকে প্রচুর জায়গা, নিভৃতে কূজনে অনুরাগ বিরাগ, যেন একদম মাখা সন্দেশ। বাইক আর সাইকেল চালিয়ে বহু ছেলে এবং মেয়েরাও পড়তে যায়, টিউশানি বা স্কুল, মাঝে সাইকেল বা বাইক হাঁটিয়ে প্রেম, বা বাইকের পেছনে বসিয়ে হাওয়ার বেগে উড়ে যাওয়া, এত খুব সাধারণ ব্যপার। যেহেতু এখানে কর্মক্ষেত্রে প্রচুর ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার, তাদের ছেলে মেয়েদের ও প্রধান টার্গেট থাকে সেটি হওয়ার। ফলে পড়াশোনা তে প্রতিযোগিতা মূলক মনভাব বা রেশারেশি খুব বেশি। এমন ও হয়েছে, টিউশানির মাত্র একটি ছেলেই কোনো এক মেয়ের সাথে নোটস শেয়ার করার ফলে তাদের মধ্যে ওই নোটস আদান প্রদান করতে করতেই প্রেম নেমে গেছে। রূপ দেখে প্রেমে পড়া নতুন কিছুনা। কিন্তু নম্বর দেখে অনেক মেয়েই অনেক ছেলের প্রেমে পড়েছে এবং উল্টো টাও ঘটেছে। অনেকের কাছে প্রেমের প্রস্তাব এসেছে, সে ক্লাস এ ফার্স্ট, সেকেন্ড বা প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে থাকে বলে। ডেভিড হেয়ার স্ট্রিট এ থাকা মৌলি যেমন শোনা গেছিল, তার দিদির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তার প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। সে পড়াশোনা তে তুখোড় বলে তার বাবা মা সব জেনেও তাকে কিছু বলতোনা। বস্তুত, একটা জিনিস এখানে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখানে বাবা মা দের বা ছেলে মেয়েদের মুখ্য উদ্দেশ্য হল, যাই কর, যার সাথে ঘোরো না কেন, নম্বর এর ক্ষেত্রে যেন কোনো ওঠাপড়া না থাকে। শোনা যায় চন্ডীদাস এর মৌপিয়া র সাথে ওখান কার ই শৌনক এর খুব রেশারেশি, স্কুল এ তারা প্রায় সমানে সমানে টক্কর দেয়। ১১-১২ ক্লাস এ মেন টার্গেট থাকে আই আই টি বা জয়েন্ট। কোনোটাই না হলে নিদেন পক্ষে যেন হাইয়ার সেকেন্ডারি টা ভাল হয়। দূর্গাপুর এ এন আই টি থাকার জন্য প্রায় সব ছেলে মেয়ে রা যারা এসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা র জন্য বসে তারা নয় ওখানের প্রফেসর দের কাছে বা প্রাক্তন প্রফেসর দের কাছে দু বছর আদা জল খেয়ে লেগে থাকে। সেখানেও নম্বর পাওয়ার রেশারেশি। তা শোনা গেল এহেন মৌপিয়া আর শৌনক নাকি হঠাৎ করে প্রেম করছে। তারা বুঝেছে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া হলে আখেরে তাদের ই লাভ। যদিও, সেই প্রেম হাইয়ার সেকেন্ডারি পাস করার পরেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেছিল। দূর্গাপুরের মেয়েদের একটু ডাকাবুকো বলে বদনাম আছে। সুনাম ও হতে পারে অবশ্য। তা এখানে বাইক বা স্কুটি বা সাইকেল চালানোর খুব চল। মেয়েরাও বাইক চালায়। সেখানে দেখা যেত বিধান চন্দ্র ইন্সটিটিউট এ পড়ে মোনালিসা, তার দশাসই চেহারা, বাইক চালিয়ে আসে, সে স্কুলের পরে বাইরে বাস স্ট্যান্ড এ একসাথে দুটি ছেলের সাথে বসে থাকতো। দুজন দুপাশে। পরে জানা গেল তাদের নয়, সে যাকে মাঝে মধ্যে বাইক এর পেছনে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো তাকেই বিয়ে করেছে। হয়তো ওর চেহারার সাথে একটি ছেলে মানাতো না। তাই দুজনের সাথে বসতো। সি- জোনের হিনা র প্রেম বহুদিনের, সেই প্রাইমারী থেকে। ছেলেটিও খুব ভাল ছিল, পড়াশোনা তেও তুখোড়, বাড়ির অবস্থা ভাল ছিলনা, কিন্ত সবাই জানতো সে আই আই টি বা জয়েন্ট নিশ্চয় পাবে। বাবা ডি এস পি তে সামান্য শ্রমিক। সেই ছেলেটির এইচ এস এর সময় জন্ডিস এ পড়ে একটি বছর নষ্ট হল। পরের বারে দিয়ে সে জয়েন্ট পেয়েছিল, কিন্তু জানা গেল তার ব্লাড ক্যান্সার এবং ভর্তি হওয়ার মতন শারীরিক অবস্থাও তার ছিলনা। বছর খানেক পরে সে মারা যায়। হিনার তারপরে কি হল, আর কেও খবর রাখেনি। সব প্রেমের অন্ত সুখের হয়না, তবে প্রেম চিরস্থায়ী হলেও তার প্রটাগনিস্ট রা শুধু নাম হয়েই রয়ে যায় প্রেমের মাধুর্য টুকু জানা যায়, বিরহের পরিনাম বেশির ভাগ সময়েই ধামা চাপা পড়ে যায়। মানুষ শুধু সুখি হতে চায়। দু:খ বেদনা ভুলে থাকতে চায়। শুধু প্রেম অপ্রেমের নীরব সাক্ষী হয়ে থেকে যায় শিল্প নগরী দূর্গাপুর।