আদিরাশাহ মা বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে তিনহাজার টাকা আদায় করেছে। তারপর গেল সেই মস্ত জুতোর দোকানে। বিদেশী ব্র্যান্ড,এখন এই ছোট্ট শহরেও খুলেছে তার আউটলেট। অনেক অপশন থাকে না,তবুও যা আছে যথেষ্ট। বিষ্টুপুরে ঘুরতে গেলে আদিরা ঐ দোকানটার কাঁচের ওপিঠে নজর ফ্যালে। দেখে এক তন্বী ম্যানিকুইনের সাদা পায়ে লাল স্টিলেটো। লাল দুটি সিল্কের লেস ক্রিসক্রস করে হাঁটু পর্যন্ত বাঁধা। আদিরা ঠোঁট ফুলিয়ে আম্মিকে আব্দার করলো -“খরিদ দিজিয়ে না। ”
শায়রা চোখ কপালে তুলে বললো-“ইয়া আল্লাহ । তিনহাজার কি চপ্পল!!বাছা,আমাদের কি সেই হ্যাসিয়ত!”
মেয়ে গোঁসা করলো। তাদের দুকামরার ছোট কোয়ার্টারে আঁধার নেমে এলো। ক্যাঁচ করে লোহার গেটটি ঠেলে আলম ঘরে ঢুকে দ্যাখে তার আংরেজি স্কুলে পড়া হুরির মুখে অকাল মেঘ। আলম বলে-‘কি হলো বেটি!’তখন
শায়রা চপ্পল বৃত্তান্ত শোনায়। বাপের চোখ কপালে ওঠে। -” বলিস কি রে মা!তিনহাজারে এই চারজনের সংসারে আধা রেশন আসে–তোর ভাইজান এবার নোকরিতে ঢুকলো সবে ট্রেনি হয়ে,তোর বাপ প্রমোটি,ঠেকনা দিয়ে দিয়ে সুপারভাইজার,তার মেয়ের জন্য তিনহাজারি চপ্পল !!”এই লম্বা রাস্তার দুধারে যতো কে-টু কোয়ার্টার আর লম্বা গাছের ক্যানোপি ,ঐ দূরের দলমা পাহাড় কেউ শুনেছে এ আজীব বাত। ।
ঝাপটা দিয়ে উঠে চোখের জলে,নাকের জলে এক হয়ে আদিরা বল্ল-“স্কুল সোশ্যালে কি ভিখারির মতো যাবো?বন্ধুরা সেদিনের জন্য সেলন বুক করেছে,ডিজাইনার ড্রেস আর ট্যাটু—তার তো কেবল একটা জুতোর আব্দার!”
শায়রা গজগজ করতে লাগল-“তখনই বলেছিলাম কনভেণ্টে না দিয়ে হিন্দি মিডিয়মে দাও। আমার পাটনার বোনের মেয়েকে দ্যাখো,যেমন রূপ‘তেমন তামিজ।”
আদিরা এ কথায় আরো ফুঁসে ওঠে আর কাঁদতে বসে। বাপের মনে ভালোবাসা টলটলায়। মাঝরাতে স্বামী স্ত্রীর একান্ত বিছানার তোষকের নিচ থেকে চাবিটি বেরোয়। লকার থেকে দুহাজার আর বাবার জেব থেকে পাঁচশো। মায়ের আটার ডিব্বায় চারটি একশো,বাকি একশো মেলায় কেনা চুক্কাটি ভাঙলেই। শায়রা বলে-“তুমি ওর মাথা খাচ্ছ। আমীর আমাদের বুঝদার ছেলে। কখনো এসব ফালতু কি ডিম্যান্ড করে নি।”
আলম বলে-“আদিরা কি আম্মি!! আমি একা মাথা খাচ্ছি!তুমি নও!!” বলে কিন্তু প্রবল একটি খুশিতে ভরপুর শোনায় তার গলা। মেয়ের আব্দার,বউ আর সংসার সব সে দিব্যি সামলাচ্ছে তো। এখনও তো একাই। সামনের মাস থেকে না হয় ছেলের ব্যাঙ্কের খাতায় চার পয়সা ঢুকবে।
তারপর ভয়ানক সফল দম্পতির মতো তারা শান্তির ঘুম ঘুমোয়। এর হাত অন্যে ধরে থাকে। আমীরও দিনভর খেটে আঙিনায় খাটিয়া পেতে নিঃসাড় ঘুমোয়। কেবল আদিরা জুতোর স্বপ্ন চোখে নিয়ে জেগে থাকে একলা।
অবশেষে মাসের বাইশ তারিখে সেই তিনহাজারি চপ্পল কেনা হয়। এর জন্য কয়েকটি হিসেব এদিক সেদিক হয়,
আলম স্কুটারের বদলি সাইকেল চেপে কারখানা যায় হপ্তা খানেক।
আদিরা তার সবেধন কালো ড্রেসটির সঙ্গে পাঁচইঞ্চির স্টিলেটোটি পরে। খুব একটা মানানসই হয় না কারণ ড্রেসটির আখাম্বা ঝুল। নিদেনপক্ষে নিলেন্থও হতো যদি তাহলেও তার জুতোর ক্রিসক্রস লেসের বাহারটি দেখানো যেত।কিন্তু সে উপায় নেই।
ইদানিং আদিরার পনেরো বছরের রক্ত গরম হয়ে ওঠে প্রায়ই। যখন ওর ক্লাসের অনীশা অডি থেকে নামে,কীর্তিরেড্ডি জুবিলি গল্ফে রানারস আপ হয় তার খুব রাগ হতে থাকে। এ সবই তার ধরা ছোঁয়ার অনেক বাইরে। এক ক্লাস,এক মেধা,বরং পড়ায়সে এগিয়েই ,তবু কত কিছু তার স্বপ্নেরও বাইরে। এমন কি নীলেন্থ স্কার্টও! এ সব সময়ে তার কে-টু কোয়ার্টারের ঐ রাস্তাটাকে হিড়হিড়িয়ে টেনে দুনিয়ার বাইরে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। নিজের জন্মবৃত্তান্তও।
আলকোর হোটেলের ব্যাঙ্কুয়েট হলে এবার ক্লাস সোশ্যাল তাদের। আদিরা ঠিক করেছে মেহুলের বাড়ি অটো করে যাবে। সেখান থেকে ওদের গাড়িতে হোটেল।সাজতে গিয়ে দেরি করে ফেললো খুব। তার উপর বাধ সাধছে পায়ের হিল। খুব মেপে মেপে হাঁটতে হচ্ছে আদিরাকে। দুবার পা মচকাতে গিয়ে সামলালো সে। ভাইজান আর আব্বু দুজনেরই বি সিফ্ট ডিউটি। কে তাকে পৌঁছে দেবে মেহুলের বাড়ি?
অতিকষ্টে শেয়ার অটো ধরে মেহুলদের কলোনি।ওদের বাঙলোটা বড় রাস্তা থেকে বেশ ভিতরে। অগত্যা তাকে হাঁটতে হলো আবার খানিকটা। আবার ধীরে ধীরে ও মেপে। সে গিয়ে দেখলো শেষ বিকেলের কালচে আলোয় আন্টি লনে বসে চা খাচ্ছে আর পোষা পাগটা কুতকুতিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। তার গায়ে উঠে আহ্লাদ করলো খানিক।
আন্টি তাকে দেখে খুব আপশোষ করলো-“ও গড!এতো দেরি করলে,মেহুল এই দশমিনিট হলো বেরিয়ে গেলো!তোমার তো কন্টাক্ট নম্বর ওকে দাও নি,তোমার কোয়ার্টার নম্বরও তো সে জানে না। উ আরঅলরেডি লেট। । কি করবে তুমি?”
আদিরা বলে ঠোঁট চেপে -“দেখি। ”
সে মাপা পায়ে বের হয় আসে ফের। আন্টি চা খায়।
আদিরার মনে হয় তার মাপের থেকে ছোট অথবা বড় ঐ জুতোজোড়া। মনে হয় এই জুতো ঠিক হাঁটার জন্য নয়। গাড়ি চড়ার জন্য স্রেফ। খটখট আওয়াজ ওঠে নির্জন রাস্তায়। গাছের মাথায় সন্ধ্যা নামে। কিচমিচ করছে পাখপাখালি। বড় রাস্তাটাও নিঝুম। নিঃশব্দ। সে পার্সে সাকুল্যে একশো টাকা নিয়ে বের হয়েছে। ঐ জুতো কেনার পরে এর চেয়ে বেশি পয়সা চাইতে প্রবল সঙ্কোচ হয়েছে আদিরার। কি করে যাবে সে একলা একলা অতোবড় হোটেলে। সে রাস্তায় শেয়ার অটো চলে না যে। আবার মেপে মেপে অনন্ত পথ হাঁটা!! অসম্ভব । নিজের আটপৌরে জুতোজোড়ার জন্য মন কেমন করে যেন। তার কান্না পায় খুব। মেহুলের উপর অভিমান হয়। আর সেই লোহার গেটের বেঁটে কোয়ার্টারটার উপরেও। হুস হুস করে অটো গুলো ছেড়ে দিতে থাকে আদিরা। একটা নোংরা লোক পাশে এসে দাঁড়াতে হুঁশ ফেরে তার। সে দুকদম সরে দাঁড়ায়। লোকটা ভিনভিন করে বলে-“হেই!পার্ক যায়েগি,মেরে সাথ?”
তখনই অটোটা এসে দাঁড়ায় পরিত্রাতা হয়ে। না চাইতেও উঠতে হয় তাকে,কে-টু কলোনির ঘরটাতে ফিরতেই হয়। গুমরাতে থাকে আদিরা।
সন্ধে সাতটার মধ্যে গেট খোলার আওয়াজে শায়রাবিবি উঁকি মেরে দ্যাখে হাতে জুতো নিয়ে দুদ্দাড় করে ঢুকলো মেয়ে। মুখ চোখ যেন জুতোজোড়ার থেকেও লাল। সে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে লেসি স্টিলেটো। মা বললো-“কি হলো আদি?এতো জলদি!”
চিৎকার করে ওঠে আদিরা-“পারি নি যেতে!ওখানে যাওয়ার হেসিয়ৎ আছে আমার?এক মোবাইল তক নহী হ্যায়ঁ মেরে পাস-”
মা কপাল চাপড়ে বলে-“তিনহাজারের জুতো হলো এখন মোবাইল ?বাপ মা কে বেচে দাও বত্তমীজ। ” আদিরা ধড়াম শব্দে দরজা বন্ধ করে।
বাপ আর মা এক বুক অক্ষম ব্যথা নিয়ে সারা রাত জেগে থাকে। পারা যায় না,সব সুখ নিয়ে আসবে মেয়ের জন্য সাধ্য কি তাদের?
আদিরা আর তার জুতোজোড়া দুটি প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে এ ওকে দেখতে থাকে রাতভোর।
অবকাশে একটি নিটোল বরফের চাঁদ ওঠে আর পাহাড়িয়া শহরে শুখা হাওয়া বয়। খোলা আঙিনায় গুলমোহর ঝরে পড়লো থোকা থোকা।