ইনগ্রিড

সোমদত্তার ভার্না শেষ বাঁক টা পেরোতেই, এক ঝাক ভুট্টা হলুদ বদ্রী আকাশ কাঁপিয়ে উড়ে গেলো। অদ্ভূত শান্ত চারিদিক, কে বলবে সিলারি গাঁও যাওয়ার পথে দিন দুয়েক আগেও কি বেগ পেতে হয়েছে তাকে। ছিমছাম ‘ থার্স্টি ‘ তে ঢুকে, উরুন কে টুকটাক ব্যাবসায়ীক হালচাল জিজ্ঞেস করে, সোজা নিজের কেবিন কাম প্রাইভেট চেম্বারে চলে গেলো সে। শেষ চারদিন তার অমানুষিক পরিশ্রম গেলো, তবে শ্রান্তিতেও স্বস্তি পাচ্ছে সে। আর তার অন্ধকার অতীত পিছু ধাওয়া করবে না, আর তাকে কালিমালিপ্ত হতে হবে না। শুধু মাঝেমধ্যে একজোড়া করুণ চোখ ভেসে উঠছে মনে। সত্যি, শয়তান ও কতো অসহায়…… একটা সময়ের পর। প্রাণপণে সেসব সামলে, কেজো হিসেবনিকেশের খাতা খুলে বসলো সে।

মাউন্টেন লাভ লিকার এর গ্লাসে ছায়া পড়ছে জানালার ধারের কাঠবাদাম গাছটার। তিরতির করে কাঁপছে পাতাগুলো আর সন্ধ্যের মুখে মুখে ট্যুরিস্টদের কলতানে ভরে উঠছে তার স্বপ্ন, বাঁচার অবলম্বন ‘ থার্স্টি ‘।

উরুন খুব বিশ্বাসী, নাহোক চারদিনে জমজমাট ব্যাবসার খোলনলচে জানা লোক কিছু না কিছু তো হাপিস করবেই কিন্তু এ সাচ্চা পাহাড়ি, বাহাদুরের জাত।

উঠে, কাবার্ডের তাক ধরে টান দিতেই একটা পাকানো কোর্টপেপার হাতে এসে ঠেকে সোমদত্তার। নাহহ, আর কাজে মন বসবে না আজ। একটা আরামদায়ক স্নান সেরে কম্বলের নীচে ঢোকে ও।

নীচের মোৎজার্টের টুংটাং এর সাথে কাঁপতে কাঁপতে কিছু দৃশ্য মনে পড়ে যায়। মা অতিরিক্ত রুপসী ছিলেন আর বাপ বেহেড মাতাল। প্রায় সব সন্ধ্যেয়, মাকে মুখে, চোখে রঙ মেখে তার বাবার সাথে কোনো না কোনো পার্টিতে যেতে হোতো। মায়ের মুখটা বিসর্জনের প্রতিমার মতো লাগতো তার, শুধু এটুকু বুঝতো….. খুব খারাপ কিছু হচ্ছে। সেদিন স্কুলফেরত বাড়ির সামনে যখন পার্থকাকু, সমীর দার দল আর রমাকাকিমাদের দেখতে পেয়েছিলো.. ধ্বক করে উঠেছিলো বুকটা; তবে মায়ের গলার নীল দাগটা ছাড়া মা ছিলো আনন্দে, শান্তিতে.. গভীর ঘুমে। ভালো লেগেছিলো দেখে সোমদত্তার। যাক, মা মুক্তি পেলো অবশেষে।

Ingrid

সপ্তাহ ঘোরার আগেই, বাবা তার ঘরে এসেছিলো। মায়ের মতো সুশ্রী না হলেও গঠন তার দুর্দান্ত। সেই গঠন বার বার চাউনিতে গিলে নিয়ে একছুটে বেরিয়ে গিয়েছিলো লোকটা, তার বাবা। গভীর রাতে ফিরে এসেছিলো হাতে প্যাকেট আর বাক্স নিয়ে…. বিছানায় উপুড় করে দিয়েছিলো রঙবেরঙ এর স্কার্ট, টিউনিক, চোলি, কাজল, লিপ্সটিক, পারফিউম আরো কত কি। অভ্যেস ছিলো না তার এসবে, তাই ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিলো সে। একটা সাদা স্কার্ট আর মেরুন টপ এগিয়ে দিয়ে বলেছিলো তার জন্মদাতা….. আজ তোর প্রথম রাত, সেনসাহেব যেনো খুশী হন। হু হু করে কেঁদে উঠছিলো বছর সতেরোর মেয়েটা, এটুকু বোঝার মত জ্ঞান তার হয়েছিলো….. কিসের প্রথম রাত। এক ছুটে পালাতে গিয়ে দেখেছিলো দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।

অনেক রাতে ক্ষিদেয় তার ঘুম ভেঙে যায় আর খাট থেকে উঠতে গিয়ে চমকে ওঠে সে…. দু হাত দূরেই এক অপরিচিত লোক বসে আছে। তাকে ঘুম ভাঙতে দেখে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে তার দিকে….. আর তারপর শুধুই যন্ত্রণা।

অনেক পিড়াপিড়ি করে পড়াশোনা টা চালিয়ে যেতে পারে সে, বুঝতে পারে আশেপাশের সকলে তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছে, সে যেনো অচ্ছুৎ। নিতান্তই পালাবার পথ নেই বুঝে, সে তার বাবার কার্যসিদ্ধিই করে চলে…. হাসিমুখে, রঙিন হয়ে। শুধু মায়ের ছবিটা ছোট করে কেটে হারের লকেটে গেঁথে নেয়। বাড়ি থেকে হোটেল, হোটেল থেকে অন্য শহর…. তার গন্ডি বাড়তেই থাকে। আর শরীর হতে থাকে অত্যাচারের আখড়া। মুখ বুজে, লকেট চেপে যন্ত্রণা চারিয়ে নেয় সারা শরীরে। এই ওর জীবন, ভবিতব্য বুঝে নেয়।

সেদিন আকাশ ছিলো থমথমে, সিমলার এক ছোট্ট প্রাসাদে তাকে পৌছে দিয়ে গিয়েছিলো তার বাবা। যেমন হয়, দুচার কথার পর সেই রাতের ঈশ্বর তার চাহিদা চরিতার্থ করতে তাকে কাছে আসতে বলে। Ingrid 2কিন্তু অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরেও এগিয়ে আসেন না তিনি, হু হু করে কেঁদে ওঠেন। হকচকিয়ে যায় সোমদত্তা, আবার কি কিছু ভুল করে বসলো সে। বেশ কিছু সময় পর তিনি কিছু কথা বলেন সোমদত্তাকে, শুনতে শুনতে ভাষা হারিয়ে ফেলে সে। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তা ছিলেন তিনি, একরোখা আর কঠোর ন্যায়পরায়ণ। কিন্তু অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে না পারার কারণে এক শয়তান চক্র পরিকল্পিতভাবে তার একমাত্র কন্যাসন্তান কে ধর্ষণ ও খুন করে। কিচ্ছু করতে পারেননি তিনি কিন্তু রোখ চেপে যায় তার আর তারপর থেকে বিভিন্ন পতিতালয় রেইড করে ফুলের মতো মেয়েগুলোকে মুক্ত করাই ছিলো তার কাজ। আজ ছমাস তিনি অবসরপ্রাপ্ত কিন্তু নিজের কর্তব্যে অবিচল, নিজের মাইনেকরা কিছু লোক দিয়ে খোঁজখবর করেন অল্পবয়সী দেহোপজীবিনীর আর তাদের সাক্ষাতে সবটুকু শুনে বুঝে নেন তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার মাত্রা।

তারপর…… মুক্তি।

মিঠে কলিং বেল টা বেজে উঠলো প্রাইভেট চেম্বারের, সোমদত্তা ভীষণ অবাক। বাবাই এসেছেন। ওহহহহ, আলাপ করিয়ে দি, ইনি মিঃ কাজী…. সোমদত্তার বাবাই। সেই যে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা, সেই রাতেই ঠিক হয়েছিলো সোমদত্তার ভবিষ্যৎ। একমাত্র মেয়েটার মুখের সাথে অদ্ভুত মিল পেয়েছিলেন তিনি।
আর নরকে ফিরতে হয়নি সোমদত্তাকে আর তার নরকের কীট বাপও পেয়েছিলো উচিৎ শিক্ষা। অভাব অনটনে লোকটা পাগল হয়ে গিয়েছিলো, সব শুনে কেঁপে উঠেছিলো সোমদত্তা….. নাহ ঈশ্বর এখনো আছেন, পাপী শাস্তি পায়। মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেই আজ লোকটা কে রেখে এসেছিলো সিলারির ‘ পিস ‘ এ, জন্মদাতা তো যা হোক। আর মা মরা মেয়ের নামে একফালি জমি কিনেছিলেন মিঃ কাজী, ঠান্ডা পানীয় বড় পছন্দ ছিলো মেয়ের। এক মেয়ের উপহার দিয়ে আরেক মেয়ের পায়ের মাটি শক্ত করে দিয়েছিলেন তিনি। পাহাড়ের মানুষের কৌতুহল কম তবে তারা সহানুভূতির ছদ্মবেশে কাঁটা ঘা বিষতে আসে না।

তাই সোমদত্তা আজ ইনগ্রিড, ইনগ্রিড কাজী। এখন তারা বাপবেটিতে বসবাস করে শান্তিতে….. দুজনের অভাবের পরিপূরক হয়ে ।।

 

Avatar

নবনীতা গুপ্ত মজুমদার

Cooking is my passion, homemaker by profession.... And there is a dream to own a FOOD RESTAURANT.....

More Posts

Related posts

One Thought to “ইনগ্রিড”

  1. Avatar Anindita

    খারাপ লাগা…. ভাল লাগা…. আর শেষমেশ জয় সেই ভালোলাগার

Leave a Comment