নির্মাল্য স্মরণে – “বইপাগল ছেলেটা”

“যারা নিয়মিত বই পড়তে অভ্যস্ত নন বা খুব একটা পছন্দ করেন না বা খুব কাজের চাপে সময় পান না তাদের কাছে আমার এই অনুরোধ যে আপনাদের হাতের কাছে রয়েছে এমন যে কোন বই তুলে নিন ও প্রতিদিন নূন্যতম একপাতা করে পড়ুন।দেখবেন আপনার ভালো লাগবে।”FB_IMG_1469624538986 (1)নিজের ফেসবুকের দেওয়ালে বার বার এই আবেদন জানাত ছেলেটা। সে নিজেও যেমন বইপাগল ছিল তেমনি সবসময় চাইত তার আসেপাশের মানুষজনও যেন বাজে কাজে সময় নষ্ট না করে সেই সময় বই পড়ে। সে চাইত অন্যকোনো নেশায় অর্থ ব্যয় না করে সেই অর্থ যেন মানুষ বইয়ের জন্য খরচ করে। ছেলেটা নির্মাল্য চ্যাটার্জি। তার নিজের ছিল বইয়ের নেশা। আর প্যাশন ছিল সেই নেশা শুধুই ব্যক্তিগত না রেখে চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার। সেজন্যই সে ভার্চুয়াল মিডিয়া ব্যবহার করে গড়ে তুলেছিল এপার বাংলায় বই নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রুপ – “বইপোকা” এবং পরে সেই গ্রুপ থেকে বেড়িয়ে “সাহিত্য সরণি” নামে অপর একটি গ্রুপ। এসব গ্রুপে বই নিয়ে আলোচনা করা, বইয়ের রিভিউ দিয়ে মানুষকে বিভিন্ন বই সম্পর্কে উৎসাহী করে তুলে সেই বই তাকে কিনিয়ে পড়তে বাধ্য করা, পূজাবার্ষিকী বাজারে আসতে না আসতেই সেগুলো কিনে হামলে পড়ে নিয়ে ঝটপট বাকিদের অবহিত করা – এমন অনেক কাজই সে করত নিঃস্বার্থভাবে সাহিত্যকে ভালোবেসে। বললে একটুও বাহুল্য হবে না যে ছেলেটার “বইপোকা” ও “সাহিত্য সরণি” গ্রুপ সংক্রান্ত কাজ কারবারের ফলে বাংলা বইয়ের বিক্রি বেশ কিছুগুণ বেড়েছে।  আবার বিক্রি বাড়ার ঘটনা শুধু জনপ্রিয় বাংলা উপন্যাস ছোটগল্পের ক্ষেত্রেই না, বরং এর বাইরেও নানা বিষয় সংক্রান্ত বইয়ের খবর জেনে সেসব বই কিনতে মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠেছে।  শুধু বই পড়াই নয়, উঠতি লেখকরা যাতে নিঃসংকোচে লিখতে পারে সেজন্য এই গ্রুপ গুলিকে এক একটা মঞ্চ হিসাবে তৈরি করতে অন্যান্য সঞ্চালকদের সাথে নিয়ে সে করে গেছে ইভেন্টের পর ইভেন্ট। আর যখন ওর তৈরি গ্রুপ থেকে লিখতে লিখতে অনেক উঠতি লেখকের লেখা ছাপা হয়েছে বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিন থেকে বিখ্যাত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছেলেটা হেসেছে বিজয়ীর গর্বিত হাসি। এভাবে শুধু সাহিত্যকে ভালোবেসে তার ছাব্বিশ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে সে একছাতার তলায় নিয়ে এসেছে এক এক করে প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষকে। সমানে উৎসাহ দিয়ে গেছে সাহিত্যচর্চায়। হ্যাঁ, এখন অনেকেই ভাবতে পারেন এ তো শুধুই ফেসবুকে সময় নষ্ট করা। এমন চিন্তা ভাবনাকারীদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলার যে, ভার্চুয়াল মিডিয়া দিন দিন যেভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে একদিন এই মিডিয়াই হয়ে উঠবে মত প্রকাশ থেকে শুরু করে লেখালিখি বা ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম, আর সেদিন যার বাংলা সাহিত্যকে ভার্চুয়াল মিডিয়ামুখী করে তোলার প্রধান কৃতিত্বে যার নাম পুরোভাগে থাকবে সে এই ছাব্বিশ বছরের মিতবাক স্বল্পায়ু ছেলেটা। সে নিজেও লেখালিখি বা আঁকার কাজটা মন্দ করত না। কিন্তু অন্যের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নিজের হাত যে সবার আগে বাড়িয়ে দিচ্ছে সেই ছেলেটারই নিজেকে প্রকাশ করতে ছিল তীব্র অনীহা। তাই তার স্বল্প লেখালিখি রয়ে গেছে নিজের ডায়েরি আর ফেসবুকের টাইমলাইনে।

একটু ভাবুন তো আজকের ব্যস্ততম দুনিয়ায় যখন আমরা সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, পাশের ঘরেই যে মানুষটা থাকে তার খোঁজ নেবার সময় বা ইচ্ছার চরম অভাব তখন সদাহাস্যমুখের পরোপকারী ছেলেটা নিজের কথা ভাবার বাইরেও ভেবে গেছে অন্যের কথা। অন্য অনেক মানুষকে করে তুলেছে সাহিত্যমুখী। তাই আসুন না সবাই আমরাও নির্মাল্যের স্বপ্নের সরিক হই। ওর দেখানো পথে হই সাহিত্যমুখী। আরো বেশি করে বই পড়ি, লেখালিখি করি। ওর অসমাপ্ত কাজ পূরণ করার জন্য আরো অনেক বেশি মানুষকে ওর দেখানো পথে করে তুলি সাহিত্যমুখী। এতেই ওঁকে  জানানো হবে প্রকৃত সম্মান।

Avatar

Sucharita Dutta

স্কুলশিক্ষিকা

More Posts

Related posts

Leave a Comment