হাসি

HASHI

বিদেশে বেড়াতে গিয়ে অদ্ভুত একটা জিনিস লক্ষ্য করি। সকালবেলা তৈরি হয়ে লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে, এক মহিলা যেতে যেতে আমার দিকে চেয়ে হেসে বলে যায় –“গুড মর্নিং”। অবাক হই। চেনা নাকি? লিফটে ঢুকতে দেখি এক অল্পবয়সী জুটি, তারাও হেসে বলে, “গুড মর্নিং”।আমার একটু নাম ভুলে যাবার অভ্যেস। সবাইকে বলা আছে, দেখা হলে আগে নিজের নামটা বলে তারপর যেন অন্য কথা শুরু করে, তাতে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলা হবে না। তা বলে মুখ তো আমি সচরাচর ভুলি না। তাহলে এদের চিনতে পারছি না কেন? তবে নিশ্চিত আমায় আজ একটু বিশেষ রকমের ভালো দেখাচ্ছে! ভাবতেই শো কেসের কাঁচে মুখটা এক ঝলক দেখে নি। ম ম ম … ঠিক আছে … তবে … মুখ ফেরাতেই এক ভদ্রমহিলার সাথে চোখাচোখি। স্মিত হেসে তিনি বললেন -“হেল্লো”। আর ঠিক তখনি আচমকা উদয় হয় – ও হরি, আমার জন্য নয়, এরা সবাইকে দেখেই এইরকম হাসে। সত্যি তো , এমন কেন হবে যে, হাসি শুধু বরাদ্দ থাকবে চেনা প্রিয়জনদের জন্য? অচেনাদের দেখে হাস্তেই বা মানা কিসের? যে দেয়, তার খরচ নেই, যে পায়, তার ক্ষতি নেই। আমার যেন দিব্যদৃষ্টি খুলে যায়। তখন আর একটু অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে উঠি। এটাই যদি সম্ভব, তো একটু মক্সো করা যাক। ইতিউতি তাকিয়ে কাউন্টারের মেয়েটিকে সসংকোচে দিই একটা হাসি ছুঁড়ে । ও মা – সে ও দিব্যি হাসি ফেরত দিল। বাঃ! এতো বেশ মজা। তারপর থেকে আমি যত্রতত্র অকারণ হাসি বিনিময়ে লেগে যাই। চেনা অচেনা মানি না। মনটা ভালো লাগে। দিনটা ভালো যায়। বিদেশ থেকে ভালো একটা জিনিস রপ্ত করে দেশে ফিরি।

সেদিন মর্নিং ওয়াকে গেছি, ভোরের মৃদু বাতাসে মন খুব প্রফুল্ল। আমারই বয়সী এক মহিলা ওদিক থেকে ওয়াক করে আসছিলেন, সামনে আসতে একটু শেখা বিদ্যা প্রয়োগ করি, স্মিত একটি হাসি ওকে উপহার দিই। মহিলা বেদম ঘাবড়ে পেছন ফিরে দেখেন কার উদ্দেশ্যে আমার হাসিটা । পেছনে কাউকে না দেখে, বিস্মিতভাবে আমায় জরিপ করতে করতে পাশ কাটিয়ে চলে যান। যাবাব্বা। পরের রাউন্ডে, চোখাচোখি করা দূরে থাক, এমন ভাবে এড়িয়ে গেলেন যেন আমি তার সঙ্গে গর্হিত কিছু করে ফেলেছি। আমি কিন্তু দমি না। ওয়াক ফেরত লিফটে মস্ত এক মহিলা মস্ত এক গোল্ডেন রিট্রিভার নিয়ে ঢোকেন। ছাঁটা চুল, স্টাইলিশ, জিম করা চেহারা। আমি হাসলাম। মহিলা সন্দিগ্ন চোখে আমার আপাদমস্তক দেখে ভদ্রতাসূচক ফিকে একটা হাসি দিয়ে সেই যে অন্য দিকে মুখ ফেরালেন, আর মাথা ঘোরালেন না। বুঝলাম, আমার গায়ে পড়া হাসিটাকে উনি সুনজরে দেখেন নি। কুকুরটা মায়াভরা চোখে আমার দিকে নাক তুলে আহ্লাদি সুরে বলে গর-র-র। গুড মর্নিং। আমি চোখ দিয়ে ইশারা করি; চুপ। বকুনি খাবে। নিজের ফ্লোর আসতে, বেরিয়ে আসি। মস্ত কুকুরের মস্ত মালকিনকে হেসে বিদায় জানাবার মতন ধৃষ্টতা আর করি না। টের পাই, হাসি ছড়ানোর প্রকল্প কাজে পরিণত করা এ দেশে একটু কঠিন হবে।

আসলে আমাদের মধ্যে তখনি হাসার রেওয়াজ, যদি চেনা কাউকে দেখি বা কোন স্বার্থ থাকে। অবশ্য ধনী প্রতিপত্তিশালী মানুষের দিকে চেয়েও যেচে হাসার রেওয়াজ, কারন তাতে নিজেদের কদর বাড়ে । কিন্তু অনামী অপরিচিতদের খামোখা সৌজন্য দেখাতে যাব কেন? তাতে আমার লাভ ? তাই হঠাত করে অচেনা কেউ হাসলে সেটা শঙ্কার কারণ হয়। সাবধান! নিশ্চয়ই কোন ধান্দা আছে।

আরেকটা ব্যাপার। এ দেশে অকারণ হাসি তারল্যের লক্ষন আর যাকে তাকে দেখে হাসা লঘুতার লক্ষন বলে গন্য।বরং, যত গাম্ভীর্য , তত তার ওজন, তত বেশী তার দর। কোন মজলিশে সবচেয়ে বেশী দেরীতে যে ঢোকে, বুঝতে হবে সবচেয়ে হেভিওয়েট সে । আর যে গম্ভীর মুখে নাক উঁচিয়ে অন্যদের তুমুল অবহেলায় নস্যাৎ করে, লকে একবাক্যে স্বীকার করে, হ্যাঁ, একটা কেউকেটা বটে । তার তোয়াজে লাইন লেগে যায়। এদিকে যে বিনা আড়ম্বরে আসে, আপনজনদের মতন সবার সঙ্গে হেসে কথা বলে, তোয়াজ করলে অস্বস্তি বধ করে, লোকে তাকে বলে ফালতু। ছোঃ এতো অনায়াসে কাছে ঘেঁষতে দেয়, এ কি একটা মেশার যোগ্য মানুষ?

অতএব অকারণ হাসি বেলানর কনসেপ্টটা এখানে চলবে না। সাধে কি স্বামীর নাম – হাসি, থুরি “হাসবান্ড”। কাজেই হাসির মতন দুর্লভ বস্তু যত্রতত্র অপচয় করবেন না। মনে রাখবেন, যেচে হাসি আর নয়। আর আগে হাসা তো কদাপী নয়। যারা বুদ্ধিমান, সফল, প্রতিষ্ঠাকামী – তারা সবসময়ে এই ব্যাপারে হিসেব করে চলে। কারণ। তারা জানে, সমাজে ওজন নির্ধারণের আসল নিরিখ – কে প্রথম চেয়ে দেখেছি, কে প্রথম দেখে হেসেছি …

Anjanaa Chattopadhyay

Anjanaa Chattopadhyay

Copywriter, Journalist, Social worker

More Posts

Related posts

Leave a Comment