মাকে আমার কাছে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য নিয়ে এলাম। ঘরে ঢুকে আমার ঠাকুরের আসনখানা দেখে খুশি হয়ে ওঠে। বাঃ, এই তো কি সুন্দর ঠাকুর বসিয়েছিস। মার প্রীত মুখখানা দেখে ছোটবেলায় ভালো রিপোর্টকার্ড আনার মত একটা অনুভূতি হয়। এখনও মার প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করার আকূলতা, মাকে খুশি করতে পারায় আনন্দ। অবশ্য পরদিনই বুঝতে পারি দেয়াল-কুলুঙ্গিতে রাখা উঁচু ওই আসনে মা পুজো করতে পারবে না। মা তো আর আমার মত চলতে চলতে শর্টকাট পুজো করে না, মার পুজো হলো ভক্তিভরে বসে দীর্ঘ সময় ধরে নানা উপকরণ আর উপাচার সমণ্বিত বিস্তারিত এক পর্ববিশেষ । অতএব ছুটি দাদার মার্কেটে আসন বসানোর চৌকি কিনতে। কারুকার্য করা মাপমত সুন্দর একখানা চৌকি কেনা হলো, তার ওপরে ঠাকুরের আসন অধিষ্ঠিত হলো এবং পাশে তাক লাগিয়ে ধূপকাঠি, শঙ্খ, ঘন্টা ইত্যাদি পুজোর সামগ্রী রাখার ব্যবস্থা হলো। এইবার কোনটায় বেশ একটা ঠাকুরঘরের চেহারা ফুটে ওঠে! মা যুগপৎ উত্তেজিত ও আনন্দিত! ঠাকুরঘর আপগ্রেড মার কাছে আমাদের ল্যাপটপ আপগ্রেডের মতই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা! একে একে তার ঠাকুরের বইপত্র এনে একপাশে গুছিয়ে রাখলো। করতালখানা ঝুলিয়ে দিল আসনের কানায়। পোঁটলা থেকে বেরোলো নিজের জলশঙ্খখানা। চন্দনপাটায় চন্দন ঘষে, দাদার থেকে ফুল দিয়ে সযত্নে আসন সাজিয়ে অনেকক্ষণ পুজো করলো মা! ধূপদীপ আর ফুলের গন্ধে বাড়িটা যেন শুচিশুদ্ধ হয়ে উঠলো।
মার প্রাত্যহিক রোজনামচার বড় একটা অংশ এই পুজো। সকালে ঘুম থেকে উঠে নারায়ণকে প্রণাম এবং স্নানের পর আর সন্ধের পর দুবেলা মন্ত্র পাঠ, গ্রন্থ পাঠ এবং গান সহযোগে নারায়ণসেবা। ভালোই লাগে। রোজ সকালে নিচের গার্ডেনে হাঁটতে যাই, এখন ওইসঙ্গে রোজ নিয়ম করে মার জন্য ফুল তুলে আনা যুক্ত হয় – জবা, কাঠগোলাপ, নয়নতারা, টগর, কখনওবা চুরি করে দুয়েকটা গন্ধরাজ। আগে বৃষ্টি হলে নির্দ্বিধায় হাঁটতে যাওয়া বাতিল করে দিতাম, এখন একদিনও বাদ গেলে মন খারাপ লাগে, ইস্, মার নারায়ণের আজ ফুল জুটলো না! বাড়ির সবার মনেও নারায়ণের হাওয়া লাগে। দিন কয়েক আগে দীপালি একটা মস্ত গোলাপ নিয়ে ঢোকে। ও মাসি, দ্যাখো কি এনেছি! ও মা! এত বড় গোলাপ কোথায় পেলি রে? ওই বি উইংয়ের বৌদির টবে হয় তো, তা বলেছিলাম আমার মাসির নারায়ণের আসনের জন্য একটা গোলাপ দেবে? আজ বলল, নিয়ে যা। ব্যস আমিও তুলে নিয়ে এলাম! সন্ধেবেলা ও অফিস থেকে ঢুকলো, হাতে সুইট বেঙ্গলের প্যাকেট । আজ নাকি গুরুপূর্ণিমা তাই একটু মিষ্টি নিয়ে এলাম। তোমার মার নারায়ণের জন্য। সেদিন এক বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা শেষে ফুড কোর্টে খাচ্ছি, ভাবলাম মার জন্যও একটু মিষ্টি নিই। বন্ধু নাছোড়, সে কিনে দেবে। অগত্যা। কিন্তু হাত ধুয়ে পরিষ্কার ভাবে তবে কিনলো। বাঃ রে, মাসিমা নারায়ণের আসনে দেবেন না এটা? আমিও শেষমেষ একটা মালি ঠিক করে কয়েকটা ফুলের গাছ লাগিয়ে নিই। সদাবাহার, রক্তজবা, টগর। বাড়ির গাছের ফুলে পুজো করার তৃপ্তিই আলাদা!
সন্ধেবেলা ঠাকুরের আসনের সামনে এক ঘন্টা গান চলে। অশীতিপর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ভক্তিনিবেদিত কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদী, গীতগোবিন্দ আর দশাবতার স্তোত্রের পাশাপাশি সহাবস্থান করে স্বামী বিবেকানন্দ, দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার, রজনীকান্ত, রবীন্দ্রনাথ। সব ফুলে পুজো হয়, সব ফলে নৈবেদ্য হয় আর সব গানে দেববন্দনা হয়। ধূপের ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে ওঠে, প্রদীপের শিখা ভক্তের বন্দনায় ঊর্দ্ধমুখী হয়, সঙ্গীতের সুরধনী ঘর ছেড়ে বাইরে শহর ছেড়ে বিশ্বচরাচরে দ্যুলোক-ভূলোক মহাশূন্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে যায়।
সেদিন ঘর থেকে শুনি কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। সে কি, মা কি একা একা কথা বলতে শুরু করল নাকি? একটু ঠাহর করতে বুঝি কথা বলছে না, কবিতা বলছে। সকৌতূহলে ঘরে গিয়ে দেখি, পুজোর আসনে বসে, কোলের ওপর খোলা সঞ্চয়িতা, নাকে চশমা লাগিয়ে মগ্ন হয়ে গান্ধারীর আবেদন পড়ছে। নারায়ণ সেবায় গান্ধারীর আবেদন?ব্যাপারটাকে কাল্টিভেট করতে হচ্ছে! পাশে গিয়ে বসে পড়ি। পূজারিনি, অভিসার, পরিশোধ,কর্ণ-কুন্তী সংবাদ, হোরিখেলা, বন্দী বীর, সাধারণ মেয়ে – রবীন্দ্রনাথের সব কবিতা প্রথম শুনেছি মার মুখে। ক্যামেলিয়ার বাবু ডেকেছিস কেনের হতচকিত চমক, মুক্তির বিনুর জন্য অশ্রুপাত, দেবতার গ্রাসের ‘সূর্য গেল অস্তাচলে। আর উঠিল না।’-র বেদনাস্তম্ভিত মুহূর্ত।সেইসব অনির্বচনীয় রসাস্বাদের স্মৃতি বসে বসে রোমন্থন করি। কবিতাশেষে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে মা আসন ছেড়ে ওঠে। বলি, বাঃ, খুব সুন্দর! কিম্তু তোমার নারায়ণকে আজ হঠাৎগান্ধারীর আবেদন শোনালে? মা সঞ্চয়িতাখানা টেবিলের ওপর সযত্নে তুলে রাখে। টিভিতে মহাভারত দেখছিলাম। মনে নানান প্রশ্ন আসতে থাকল। তখন গান্ধারীর আবেদন খুলে বসি। কী সুন্দর লিখেছেন! ধর্ম-অধর্ম, আপন-পর, ন্যায়-অন্যায় সব দ্বন্দ্ব ঘুচে যায়। সংশয় কেটে বুকটা হালকা হয়ে যায়।
মানতেই হবে, মার নারায়ণ পুজোর এই উপাচারটা রীতিমত হাটকে !
Khub sundor lekha apnar. Pore bhari bhalo laglo. Aro likhun. Aro porte chai.
Narayan, Narayan ..Asamvab Snigdha akta lekha.