না-কথা।

1st-love
শীর্ণ একটা অন্ধকার  দুজনের মাঝখানে আটকে রইলো।  ফলতঃ আমরা এক কৌনিক দুরত্ব বজায় রেখে গেলাম বরাবর।  সেই দুরতিক্রম্য অন্ধকার থেকে যে সৌরভ ভেসে এলো তা আমার চির চেনা কেলভিন ক্লেন্স।  তার প্রিয় ছিল।
অথচ অপার্থিব  আলোরা,বরাবর যেমন থাকে ,মৃদু ইন্দ্রজালে,তেমনই ছিল তাজ বেঙ্গলের লাউঞ্জে। লেমন গ্রাসের অলৌকিক সুবাস টুকুও।শুধু আমার ইন্দ্রিয়  গুলি  তার শরীরের সুগন্ধ টুকু খুঁজে নিচ্ছিল কেবল। চোখ শুধু তাকেই দেখছিল। যদিও দৃষ্টি আনত তাও  দেখলাম ,তার গাঢ় নীল ফর্মাল ট্রাউজার্সের সঙ্গে মানানসই স্টিলেটো। সে এখানে কি ভাবে? কেন?একযুগ পেরিয়ে এলে ভাঙা সম্পর্ক, হুড়মুড়িয়ে এ কৌতুহল প্রকাশ করা চলে না। লাউঞ্জের ডান দিক থেকে   নকল ঝর্ণাটি  একটানা পতনের শব্দ তুলছিল,আমি একপলকে দেখেছি তার ঝর্ণার মতো চুল পনিটেলে বাঁধা,পরিপাটী ।   অদূরে আর্ট গ্যাল্যারি র মাঝখানে ভায়োলিন এবং চেলোতে সান্ধ্য মুর্চ্ছনা ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন গুণী মানুষ দুটি। শব্দ তরঙ্গ বলতে কেবল সে টুকুই।  এ ছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সোফাগুলি, বসে থাকা একজন- দুজন,অথবা ট্র্যাভেল ডেস্কের মেয়েটি, রিসেপশনের কয়েকজন নারী পুরুষ,সকলের কথা শেষ সে দিন সেখানেই। যেখান থেকে কৌনিক অন্ধকার আড়ষ্টতায় জমাট বাঁধলো।
নৈঃশব্দ্য সে ভাঙলো।  বল্ল-চলো বসি।
মুখোমুখি সোফাতে। আমার অপেক্ষা গাড়ির জন্য,অফিস ট্যুরের ঝটিকা সফর কলকাতাতে।  রাতের ফ্লাইটে দিল্লী  উড়ান।  সেখানে কাজ সেরে পরদিন ফিরে যাওয়া।
-বেহালাতে আর থাকো না তোমরা? আমি অনেক কথামুখ  বন্ধ করে সংহত প্রশ্ন করলাম।
-না।  আর তুমি?এখন ও সেখানেই?
-হ্যাঁ ।  শিকাগোতেই।
আবার স্থির দুজনেই।  সামনের বেঁটে কফি টেবিলে,একটি ক্রিস্টাল  ভাসে উন্মুখ জারবেরা।  গাঢ় খয়েরি রঙ।  দেখলাম তার পাশেই সেই নরম হাতটি রাখা,আরও প্রসাধিত,নেলকলারের রঙ, জমাট রক্ত যেন।
তার দিকে কিছুতেই তাকাতে পারছিলাম না সরাসরি।  নারীটি আমার নয়।  ঐ পেলব ঠোঁট,অপাপ চোখ,এসব কিছুই  আর আমার নয়!
-শুনেছি মাসী  চলে গেছেন।  তোমার ফ্রেঞ্চ ওয়াইফ,একটি ছেলে।
আমি চমকে তাকালাম।  সে এতো খোঁজ রাখে।  আমি ?সত্যি বলতে মনে রাখতে পারি নি কিছুই। কলেজ জীবনের আশ্রয়,আমার চেয়ে কতো ছোট।  পালকের মতো হালকা প্রেম ছিল আমাদের।  ভুলে যাওয়াটাই অনিবার্য  তবু আজ তাকে দেখে  কতো কথা মনে ভিড় করে এলো।  নিজের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বল্লাম-তুমি আরও সুন্দর হয়েছো।  বেশ একটা কর্পোরেট লুক্ এসেছে।   একটু চমকালো বোধ হয়,অথবা হালকা অস্বস্তি।লজ্জার ভাবটি খেলা করলো কিনা জানি না। তার চোখে এতো গভীর কাজল,যেন চোখের মুখোশ!
সে আমার দিকে স্থির তাকিয়ে রইলো।
অস্বস্তিকর চাউনি।  আমি বা সে দুজনের গভীর অনীহা তেই দূরে সরে যাওয়া হয়েছিল।  তবে আজ এভাবে তাকাচ্ছে কেন?।
-কি ভাবছ?সন্ধে সাতটার সময় তাজের লাউঞ্জে কি করছি?
-কি করছো রানী ?মনে মনে বল্লাম।  মুখে রইলো না-কথারা।
-ওয়েট করছি ওয়েট।  ক্লায়েন্ট আছেন!ঠিক সাড়ে সাতটার অ্যাপয়েনমেন্ট।  সে হাসলো। -মস্ত চাকরি করি সিদ্ধার্থ দা।এই কর্পোরেট লুক টার মতোই।
আমি স্তব্ধ   হয়ে থাকি।  যা অজানিত তা জানতে ইচ্ছে করে না আর।
-রোজই আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে।  বেহালার পুরোনো   বাড়িতে রাত করে বাইরে থাকা–জানোই তো ব্যাকডেটেড মেন্টালিটির জয়েন্ট ফ্যামিলি,মা কে নিয়ে তাই আলাদা হয়েছি।  লেক গার্ডেন্সের দিকে ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাট ।
আমি বল্লাম -ভালো আছো সে তো বোঝাই  যাচ্ছে।  গুড।
-বুঝেছো।  গুড।  সিদ্ধার্থ দা,তুমি কি ভুল ইংলিশ বলতে মনে আছে?আমি ঠিক করে দিতাম। ঠোঁট চেপে হাসলো ঠিক কিশোর বেলার মতো।
-তুমি কনভেন্ট আর আমি পাতি বাংলা স্কুল ছিলাম যে।
এমন সময় গেটের পোডিয়ম থেকে বিনীত মানুষটি এসে খবর দিলেন-আপনার কার পোর্টিকোতে ওয়েট করছে স্যার।
আমার ছোট্ট লাগেজটি নিয়ে উঠে পড়লাম।  আর না-কথাদের ও।  এই যেমন–রানী,আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে জানিস।
-তুই বিয়ে করলি না কেন?
-তোর কি চাকরি রে রানী?রাত করে হোটেলে পার্সোনাল মিটিঙ–আয় রাণী,আমার সঙ্গে যাবি?
মুখে বললাম। -আসি।
সে বল্ল-ঠিক আছে।
কেলভিন ক্লেন্সের বিষন্ন আলোক বৃত্তে সে আটকা রইলো। আমাকে অনেক পথ যেতে হবে। পিছন ফিরলাম না।  সাড়ে সাত বাজতে দশ মিনিট বাকি ছিল। ।
Avatar

Barnali Mukherjee

I am Barnali Mukherjee, Masters in Bengali Literature from Jadavpur University. I am currently a housewife and a proud mother of a son. I enjoy reading, reciting, gardening and above all writing poetry and prose.

More Posts

Related posts

Leave a Comment