অভিসার

wallpaper-phone-windows-love

()

২৮ শে নভেম্বর সন্ধ্যে আটটা নাগাদ নিজের নামটা লিখে send করেছিল । সোমলতা । এক সেকেন্ডের মাথায় প্রত্যুতর আসে । মহাপুরুষ । তারপর কথা চলতে থাকে নিজের খেয়ালে , নিজের আবেগে , নিজের চাহিদায় , প্রয়োজনে । একটার পর একটা WhatsApp sms খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যত্ন নিয়ে দেখছে আজ সে । এর আগে তো কখনও smsগুলো দেখেনি এভাবে ।

“ আপনার কণ্ঠে একটি সঙ্গীত শুনিতে বড়ই সাধ হয় এখন । ”

সোমলতার উত্তর যায় ,- “ আচ্ছা বুঝলাম। ”

-কি বুঝলে শুনি একটু

-সব বোঝার উত্তর হয়না ।

কেন যে কথাটা বলেছিল কে জানে !

এই রকমি কত sms একটার পর একটা দেখতে দেখতে সোমলতার খেয়াল হল মহাপুরুষের তুমিটা আস্তে আস্তে তুই হয়ে গেছে ।

আজ সকালে রিমা ফোন করে খবরটা দিল । সোমলতা তো নিজের কানকেই বিশ্বাস করেনি । মহাপুরুষের সাথে নিয়মিত , অহরহ কথাতে তো কবেই লাগাম দিয়ে ছিল । এই তো লাস্ট ২-৩ দিন আগে কথা হল –

– কি রে পাগলী কি করছিস ?

– এই তো পড়ছিলাম

– তুই কি করে এত পড়িস কে জানে

আলতো করে একটা শুকনো উত্তর দিল সোমলতা

-হুম্ম

মহাপুরুষ চুপ । শুষ্কতার কারণ খুঁজেছিল কি ওই সময়টুকুতে ?

সোমলতার উদ্দেশ্যহীন আবার একটা কথা তারপর ,-

-হুম্ম , বল

-কাকিমা ভালো আছেন ?

-হ্যাঁ , ভালোই আছে । বল।

-না কিছু না । চল রাখছি , টাটা ।

সোমলতাও ফোনটা রেখে দিয়ে সময় নিয়ে একটা বড় শ্বাস নেয় । নিজে হয়ত সেই সময়ের মধ্যে বুঝে নিতে চেয়েছিল তার দেওয়া লাগামটা ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা ।

বেলা গড়িয়ে এখন দুপুরের দিকে এগোচ্ছে । সোমলতা বারান্দায় । রাস্তার গলির মুখে যানজটগুলো সাথে আগত শীতের রোদ ক্রমেই লেপটে যাচ্ছে । সামনের ওই পুকুর পাড়ের ভ্যাট থেকে করপোরেশনের গাড়ি নোংরাগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল । একটা সহজাত চেনা কটু গন্ধ যেন নাকে আসছে । স্নানে যেতে হবে সোমলতাকে । ওর মা একটু দেরি হলেই খিটখিট করে । মোবাইলের ব্যাটারি মাত্র ১০% । মোবাইল চার্জে দিল সোমলতা ।

(২)

সোম বাথরুমে । নিস্তেজ ভাবে খুলছে তার দেহের এক একটা আবরণ । প্রসাধনীতে কোনো কালেই তার কোনো আগ্রহ ছিল না । তাই সটান সাওয়ার খুলল । কিন্তু কয়েক সেকেন্ড সাওয়ার উনমুক্ত থাকার পরই চুপ মেরে গেল । সোম বুঝে গেছে কারণটা  । বাথরুম থেকেই চিৎকার করল,-

-মা পাম্পটা চালাও , জল নেই

-তোকে কতবার বলেছি বাথরুমে ঢোকার আগে একবার….

-উফুঃ মা , এত কথা না বলে পাম্পটা চালাও না

-দাঁড়া । চালাচ্ছি ।

জল নিয়ে এ সমস্যা গত এক দু’ সপ্তাহ ধরে হচ্ছে । নিচের ভাড়াটে নতুন ; একটা আট ন’ মাসের বাচ্চাও আছে । কাচাকাচি তো একটু বেশি হবেই । কিন্তু তাই বলে , দিনে তিন চারবার পাম্প চালানো স্মভব ! এই তো গত মাসেই প্রায় সাড়ে দু’ হাজার এসেছে ইলেকট্রিক বিল । তখন তো মাত্র দুটি প্রাণী । এ মাসে ভাড়াটেরা এলো । কর্তা , গিন্নী আর ওই কোলের বাচ্চা । তা এই সাড়ে চার জনের জন্য যদি দিনে তিন চারবার পাম্প চালাতে হয় তাহলে তো লাভের গুড় পিঁপড়েতেই খাবে আর কি ! না মায়ের দ্বারা হবে না , আজ সন্ধ্যেতে তাকে নিজে গিয়েই বলে আসতে হবে নিচেতে । কিন্তু জল পড়তে এখনও মিনিট ১০ ।

হটাৎই সোমের চোখ গেল বাথরুমের দেওয়ালে লাগানো বড় আয়নাটার দিকে । তার বাবা এই বাথরুমটা খুব শখ করে বানিয়ে ছিল । আয়নাটা থেকে দেড় হাত দূরে দাঁড়ালেই পূর্ণাঙ্গ শরীর ভালো ভাবেই দেখা যায় ।

সোমও নিজের আবরণহীন শরীরটা উল্টেপাল্টে দেখছে । তার শরীর মেদহীন নয় আবার মেদবহুলও নয় ; মানে ঠিকঠাক । নিঃসন্দেহে যথেষ্ট আকর্ষণীয় । কিন্তু হটাৎই করেই তার মস্তিস্কে কিছু ছবি ক্রমশ চলাফেরা করছে এখন । একটা ঘর – সিগারেট আর গাঁজার ধোঁয়া কুসাশার মত ছেয়ে গেছে – ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জামা কাপড় – অগোছালো বইপত্র – শরীরের ভিতর থেকে আসা একটা সঙ্কেত – সঙ্কেতে সাড়া না দেবার মরিয়া চেষ্টা – মহাপুরুষ……..

ক্রমেই ছবিগুলো দুরন্ত হয়ে উঠছে । মরিয়া হয়ে উঠছে । উফুঃ । সোম আর পারছে না । বাথরুমের ভিতরেই নিথর হয়ে ছটফট করছে । মস্তিষ্কে আসা ওই ছবিগুলোকে লাথি মেরে কোমোডে ডুবিয়ে মারতে চাইছে ।

ও কি ভুলতে চায় ? আবরণহীন সোমের এই নগ্ন মুহূর্তেই কেন ওই ছবিগুলো আসছে তার মাথায় ?

সোম ধপ করে বসে পড়ল ।

সাওয়ার থেকে জল পড়ছে । নগ্ন সোম তার প্রতিটি ভিজে যাচ্ছে । ধুয়ে যাচ্ছে ছবি , ভিজে যাচ্ছে মস্তিষ্কের উপড়ের সেই চাপটা । কিন্তু মাথার ভার ক্রমেই বাড়ছে ।

-কি রে ঝিলিক ট্যাঙ্ক ভর্তি হয়ে গেছে বলিস নি তো ?

সোমলতা চুপ । কোন উত্তর দিতে ইচ্ছেই করছে না তার । সে এখন ভিজছে । একটু একটু করে । সম্পূর্ণ।

                                        (৩)

 

এ বছরের মত শীত প্রায় দোড় গোঁড়ায় । দুপুরের খাবার পর বারান্দায় বসে আছে সোমলতা । হালকা উত্তরে হাওয়া দিচ্ছে । গায়ে একটা চাদর চাপালে মন্দ হত না । জুঁই ফুলের মৃদু গন্ধটা মাঝে মাঝে নাকে আসছে । রোববার করে প্রায়ই বাজারে গেলে সে একটা করে জুঁই-এর মালা নিয়ে আসে । তার বাবার যে জুঁই খুব পছন্দের ছিল ।

চুলটা এখনও ভিজে । শীত বা গ্রীষ্ম তার বটের নামালের মত চুল শুকাতে একটু দেরিই হয় । কোঁকড়ানো ঘন চুলের ভিতর দিয়ে বার কয়েক আলত ভাবে আঙুল চালালো । এই চুল দেখেই তো মহাপুরুষ ইয়ার্কি মেরে বলে ছিল –

চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা

নাবিক হারিয়ে ফেলে পথ ,- শুধিয়ে ছিল তারে

বলেছে সে ,- জ্যামে আটকে গেছিলেন ?

সেক্সি চোখ তুলে বলে-

সুদীপ্ত সেনের বউ সোমলতা সেন ………

সোমলতা একটা বিদঘুটে খিস্তি দিয়ে বলে ,- “এই আমি সেন নয় রে ; দাস ।”

ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই হেসে ফেললে সে । কিন্তু , হটাৎ করেই হাসিটা খেই হারিয়ে ফেলে গুম হয়ে গেল ! সোম চুপ এখন ।

-ঝিলিক , ঝিলিক

-বলো

-ঘুমাবি না একটু ?

– না গো , ভালো লাগছে না ।

-আমি একটু গড়ালাম বুঝলি ; ব্যাথাটা একটু বেড়েছে । গাটাও ম্যাচ ম্যাচ করছে ।

-ঠিক আছে ।

গত কয়েক বছর ধরে শীত এলেই মায়ের এই ব্যাথাটা বাড়ে । বয়েসটাও তো হচ্ছে । আজ বিকেলে বের হলে ওষুধটা আনতে হবে । রোববারের দিকে এখানের প্রায় সব দোকানগুলোই বন্ধ থাকে । তেমন হলে কাল কলেজ ফিরতা পথে একেবারে নিয়ে আসবে ।

একটা সিগারেট ধরিয়েছে সোম । আগে খুব খেত , কিন্তু এখন কালে ভদ্রে । হাওয়া ছেলে মানুষের মত মাঝে মাঝে এদিক ওদিক দিয়ে আসছে । যদিও তার মা এখন ঘুমাচ্ছে ডাইনিং-এর ওই দিকের ঘরে তবুও রিস্ক নিয়ে লাভ নেই । বারান্দার দরজাটা হালকা করে ভেজিয়ে দিল , বারান্দার ম্যাটগুলোকে ঝুলিয়ে দিল । চেয়ারে বসে সে এখন বারান্দার ওপারের পৃথিবীটাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে কিন্তু , ওই পাড়ের পৃথিবীর কাছে সোমলতা এখন বড় বেশী ঝাপসা – বড় বেশী আবচ্ছা ।

মহাপুরুষ একবার খুব বকাবকি করেছিল এসব নিয়ে ।

-তুই খা না । তোকে তো আমি খেতে বারণ করছি না রে বাবা ; কিন্তু একটু কম খেলে লাদেন কি আবার

বেঁচে উঠবে ??!

সোম তার জবাবে তীক্ষ্ণ ভাবে ইয়ার্কির ঢং-এই বলেছিল –

-হ্যালো মিস্টার , I’m not your girlfriend ok . এত কেয়ার আর দায়িত্ব না নিলেও চলবে । আর প্লিজ বেশী জ্ঞান দিস না তো মাইরি ।

উত্তরে মহাপুরুষ কিছুই বলেনি সেদিন । কেবল অর্থহীন ভাবে ম্লান হেসেছিল । তারপর সারা রাস্তা চুপ করেই এসে ছিল ।

কিসের জন্য চুপ হয়ে গেছিল মহাপুরুষ ?

সোমলতার তীক্ষ্ণ ইয়ার্কিটা কি তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল ?

সেই বা কেন এত কেয়ার নিত সোমলতার ?

আর সোমলতাই বা কেন তার এই শাসন করাটা , কেয়ার নেওয়াটা মেনে নিতে পারেনি ?

সোমলতা কি ভয় পাচ্ছিল ?

মহাপুরুষ ওর প্রেমে পড়ে যাবে , সেই ভয় ?

নাকি আসলে এর উল্টোটা ?

আর যদি তা হয়ও তাহলে ক্ষতি কি ?

তাহলে ঘর পোড়া গরু কি সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পেয়েছিল সেদিন ? !!

রোদ ছুটি নিতে শুরু করেছে শহরটার থেকে । সোমের মা এখনও ঘুমাচ্ছে । ডাকতে হবে এবার ; না হলে শরীরটা আরও খারাপ করবে । সত্যিই সোমলতার এখন কত দায়িত্ব । সময় দায়িত্ব নিতে শেখায় । আর তার সাথে হয়ত অনুশোচনা বা অনুতাপ করতেও ……..!!?

(৪)

                       এই সন্ধ্যেতে আর পড়তে বসার ইচ্ছে করছে না । কম্পিউটার টেবিলের সামনে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিল সোম । সন্ধ্যে হলেই বাড়িতে থাকলে দু’ কাপ চা করে । একটা মায়ের আর একটা ওর । মা বরাবরই এক চামচ চিনি খায় । সোম আগে চার চামচ খেত কিন্তু এখন দু’-এর বেশী না। কাপে আর একটা চুমুক দিল ।

একবার এক কফি শপে মহাপুরুষের সাথে কফি খেতে গেছিল । নেহাতই আড্ডা দেবে বলে । অর্ডারটা মহাপুরুষ দিতে গেছে অমনি সোম তেড়ে মেরে এলো ,-

-শালা আমি ভিক্ষারি নাকি রে ? আমি দেব বিলটা আর অর্ডারটাও ।

মহাপুরুষ হেসেছিল শুধু ।

-দুটো কফি , একটা চার চামচ আর একটা ….

মহাপুরুষের দিকে তাকাল সোম ।

-দু’ চামচ ।

কথাটা বলেই হেসে ফেললো মহাপুরুষ । ওয়েটার চলে যেতেই সোম বলে,-

-এতো দাঁত কেলাবার কি আছে রে বোকা…. ছেলে ? আমি কি তোর বউ যে ক’ চামচ চিনি খাস জানব ?

-সরি ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম । আর তুই এতো চিনি খাস কেন ? বয়েসটা বারুক তখন বুঝবি । ম্যাকসিমাম দু’ চামচ ঠিক আছে ।

-অমনি ? সুযোগ পেয়েই আবার শুরু করলি তো ! মাইরি তুই শালা জ্ঞান দিতে পারলেই ……

সেদিন রীতিমত মহাপুরুষকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাচ্চাদের মত কফি খেয়েছিল সোমলতা। আর বলেছিল,-

-আহাঃ , কি ভালো খেতে । ইস যদি আরোও ক’ চামচ চিনি পড়ত তাহলে হেব্বি হত ।

মহাপুরুষ মুচকিমুচকি হেসেছিল সেদিন ।

সোমের মোটা চওড়া পালকের মত ঠোঁট আবার কাপ ছুল । হটাৎ সে খেয়াল করল ঠিক কবে থেকে সে দু’ চামচ চিনি খেতে শুরু করল ? মহাপুরুষ বলার পর থেকেই ? ঠিক মনে পড়ছে না তো ! মথায় একটু চাপ দিয়ে দিনটা আর কারণটা মনে করতে চাইল । কিন্তু বুকটা চিনচিন করে উঠল । হাল ছাড়ল সোম ।

-কই রে তোর হল ? কাপটা দে ….

মা কখন তার চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি । সোম বাকি কফি এক চুমুকে খেয়ে মায়ের হাতে কাপটা ধরাল ।

-তোর কি কিছু হয়েছে ?

বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল সোমের । সে কি ধরা পড়ে গেছে মায়ের কাছে ! নিজেকে লুকিয়ে নিয়ে সাবধানে জবাব দিল,-

-কই না তো । কেন কি হয়েছে ?

-না , আসলে সকাল থেকে আজ খুব চুপচাপ আর মনমরা হয়ে আছিস কেমন…..

সোমলতা যেন পাত্তাই দিল না কথাটাকে ।

-ধুর….! মা কি আবার হবে … কিছু হয়নিরে বাবা …

মিথ্যেটা কি মা ধরে ফেলল ?! সোম চুপ ।

-ঠিক আছে । তুই কাজ কর । আমি বরং রান্নাটা সেরে নি ।

মা চলে গিয়েও আবার ফিরে এলো । এবার কিন্তু সোম খেয়াল করেছে ।

-বলো ? কিছু বলবে ?

-তোকে খোলা চুলে আজ বড় ভালো লাগছে রে মা ।

সোমের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ।

সত্যি সোমলতা এখন চুল বেঁধে রাখে না আগের মত । খোলাই রাখে । এটাই এখন তার অভ্যেস ; এটাই এখন তার ভালোলাগা ।

সিস্টেমটা অন করল কিছু আগে । তার Desktop-এ কালো চুড়িদার পড়া খোলা চুলের নিজেরই একটা ছবি ওয়ালপেপার করেছে । ছবিতে সে আনমনে মোবাইল নিয়ে কি যেন করছে । ছবিটা ওর কলেজের কোন

প্রোগ্রামে তোলা । মহাপুরুষের সাথে নিয়মিত কথা হত তখন WhatsApp-এ । সেদিন প্রোগ্রামে তোলা বেশ কিছু ছবি তাকে পাঠিয়ে ছিল সোম । মহাপুরুষের এই কালো চুড়িদারের খোলা চুলের এই ছবিটা বেশ পছন্দ হয়েছিল ; সে ছবিটার ক্যাপশেন দিয়েছিল মাধবীলতা । সোম হেসেই বলেছিল,-

-থাক আর ভাও খাওয়াতে হবে না ।

অথচ কি অদ্ভত ভাবে সেই ছবিটাই আজ সোমের ওয়ালপেপার । এটা কি নিছক কাকতালীয় ? নাকি এর শেকড় এতটাই গভীরে যে সোমলতা নিজেও তা টেড় পায়নি কখনও ?!!!

সোমলতার তিতির পাখীর মত চোখ দুটো কম্পিউটার স্কিনের দিকে তাকিয়ে । তার মাউস উদ্দেশ্যহীন ভাবে ডেক্সটপে পায়চারী করছে । হিসেব মেলাতে চাইছে হয়ত সে । তার আর মহাপুরুষের মধ্যে একাধিক স্তরে জমে থাকা রহস্যের সমাধান করতে চাইছে হয়ত ; হয়তবা তার নিজের মনই তাকে না জানিয়ে মহাপুরুষের সাথে কোন ষড়যন্ত্র করেছে কি না সেটা বুঝে নিতে চাইছে ……

আর তার সাথে পৃথিবীর সব মহাপুরুষেরাই তার চারপাশের মানুষদের স্বভাবে –  অভাবে , পছন্দে – অপছন্দে  কি এমন ভাবেই তাদের অস্তিত্ব জানান দেয় ? তারও উত্তর খুঁজছে এই ভর সন্ধ্যাবেলায় সোম ,- সোমলতা ।

 (৫)

রাতের খাবার বেশ কিছুক্ষণ আগেই খেয়ে এসেছে সোমলতা । মাও ঘুমাতে গেছে । খেতে যাবার আগে নিজের ফেসবুকে অন হয়েছিল , আর লগ আউট করেনি । অফ হবার আগে টাইমলাইন থেকে ট্যাগ রিমুভ করছে এখন । বেশ কিছুদিন হল ফেসবুক খোলা হয়নি ।

ঘরের আলোটা নিভিয়ে নীল রাতবাতিটা জ্বালিয়েছে । নীল আলো সোমের বেশ পছন্দের । মহাপুরুষকে কথায় কথায় এই পছন্দের কথা বলেও ফেলেছিল একদিন আড্ডা মারতে মারতে । মহাপুরুষ বলেছিল,-

-তোর ঘরের নীল আলোটা আমায় দিয়ে দিবি রে …?

সঙ্গে সঙ্গে মহাপুরুষের চোখের দিকে তাকিয়েছিল সে । খেয়াল করেছিল দুটো নিষ্পাপ চোখ যেন সোমের দিকে কতগুলো বছর ধরে শিশুর মতন তাকিয়ে আছে , সোম যেন খেয়ালই করেনি । সোম অবশ্য মুখে বলেছিল,-

-দশ টাকা দেব একটা নাইট বাল্ব কিনে নিস ।

ফোন বাজছে সোমের । চেয়ার থেকেই একটু ঝুঁকে বিছানায় হাত বাড়াল । রিমা ফোন করেছে ।

-হ্যাঁ রে বল ?

-তুই ঠিক আছিস তো !

-হ্যাঁ ঠিকই আছি ; কেন ঠিক না থাকার কি হল ?!!

রিমা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল । তারপর বলল,-

-তুই অকারনে খুব তাড়াতাড়ি পাল্টে যাচ্ছিস । কারণটা তুইও জানিস ।

আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিল রিমা ।

রিমার রাগ করাটা কি স্বাভাবিক ? যে সেতু তৈরিই হয়নি কখনও সে সেতু থাকা না থাকা বা ভেঙে যাবার জন্য ঠিক না থাকার কি আছে !!?

সোমের চোখ গেল নীল রাতবাতির দিকে । তার কানে বারবার ভেসে আসছে মহাপুরুষের সেই কথাটা,-

-“ তোর ঘরের নীল আলোটা আমায় দিয়ে দিবি রে ? ”

আচ্ছা সেতু কি বহু আগেই তৈরি হয়ে গেছিল ? সোমলতা বুঝতে পারেনি সেটা ? সত্যি যদি সেদিন সোম ওর নীল আলোটা দিয়ে তো , তাহলে কি গল্পটা অন্য রকম হতে পারত ?

কিন্তু এখন আর এসব ভেবে লাভ কি !!

হঠাৎ করেই জানলার পর্দাগুলো উড়তে লেগেছে ঝোড়ো হাওয়াতে । বারান্দায় এসে দাঁড়াল সোম । কখন যে গোটা শহরটা জুড়ে মেঘ এসেছে সোম খেয়ালই করে নি । ঠিক কি কি তার খেয়ালের বাইরেই থেকে গেছে বরাবর ?

বারান্দার দরজা আর ঘরের জানলাগুলো বন্ধ করে মায়ের ঘরে গেছিল । মা ঘুমাছিল অঘোরে । জানলাগুলো বরাবরই মা বন্ধ করে শোয় । বন্ধ জানলার কাঁচ দিয়ে আসা মৃদু রাস্তার আলোতে মায়ের মুখটা ঝুঁকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল । এই বয়েসে যা ঝড় ঝাপটা গেছে ….

বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে । ঘনঘন । সোম এখন নিজের ঘরে । তার মাথা ভারী হয়ে আসছে। গোটা শরীর জুড়ে একটা অস্বস্তি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । দম বন্ধ হয়ে আসছে সোমের ।

বৃষ্টি শুরু হয়নি এখনও । ঝোড়ো হাওয়াটা কি মেঘ উড়িয়ে দেবে ? এই ঝোড়ো হাওয়াটা যদি সোমের এই গুমোট মুহূর্তগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যায় ,- তার মস্তিষ্ক , হৃদয় , শিরা – উপশিরা থেকে দূরে বহু দূরে ….. তাহলে হয়ত একটু হালকা হতে পারবে ও । সে মুছে ফেলতে চায় , ভুলে যেতে চায় সব কিছু । মহাপুরুষের সমস্তটা ।

সোমের মাথায় দুম করে একটা অবলা বুদ্ধি অসহায়ের মত আছড়ে পড়ল । ঝড়ের গতিতে কম্পিউটারের সামনে এল সে । মহাপুরুষকে সে ফেসবুক থেকে ব্লক করে দিতে পারলেই অনেকটা হালকা হতে পারবে , ভুলে থাকা যাবে ওকে । হ্যাঁ এটাই একমাত্র উপায় তার কাছে এখন । সোম বিদ্যুৎ গতিতে টাইপ করল একটা নাম,-

A – b – h – i – s – a – r .

প্রথমে আনফ্রেন্ড । তারপর ব্লক ।

খুব জোরে কোথাও একটা বাজ পড়ল । সোমের সারা শরীর এখন এক অজানা নেশায় আক্রান্ত । আচ্ছন্ন সোম তার নিথর শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে বিছানায় নিয়ে গিয়ে ফেলল ।

সোমের চোখ বন্ধ । তার চোখের পাতার নিচে এখন মহাপুরুষের সাথে জড়িয়ে থাকা মুহূর্তগুলোর টুকরো টুকরো ছবি চলমান পোট্রেটের হয়ে শরতের মেঘর মত ঘুরে বেরাচ্ছে । সে সমস্ত মুহূর্তে সাক্ষী ছিল তারা দু’ জনে ; আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সোমলতা একা ।

বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে অঝোর ধারে । এই শহরের রাস্তা ঘাট জলে উপচে পড়তে শুরু করেছে । অথচ সোমের বুকের ভেরটা এখন কোনো গ্রীষ্মের দুপুরের মত খাঁ খাঁ করে রয়েছে । পানা পুকুর শুকিয়ে গেলে মাটিতে যেমন ফাট ধরে , সোমের হৃৎপিণ্ডে যেন তেমনই আসতে আসতে ফাট ধরছে ।

এই মুহূর্তে সোমলতার বিছানায় যে মনুষ্য শরীর সব কিছু ভুলতে আর ভোলাতে চেয়ে শবের মতন পড়ে আছে সে শরীরের নাম কি ?

সোমলতা ?

নাকি মহাপুরুষ ?

নাকি এই ঝড়ের রাতে   অভিসার ?

কে জানে ………………..

ding-dong

Avatar

Ankush Das

আমি জানি আমি জানি না । তাই খোঁজটা চালিয়ে যাচ্ছি । একটা নতুন মুহূর্ত , যা আমার ভাবনার উপসংহারের দর্পণ ; সেই দর্পণের আরও সামনে যাওয়া চেষ্টায় সিঁড়ি বেয়ে উঠছি....

More Posts

Related posts

Leave a Comment