বাড়ি থেকে আমার বিদ্যালয়ের দূরত্ব ১৫ কিমি অর্থাৎ বাইকে করে প্রায় ৩০ কিমি আসা-যাওয়া, আমার নিত্যদিনের সফর। বিদ্যালয়ে যোগদান করার পর পরই কিনেছিলাম বাইকটি।প্রথম প্রেমিকার মতো,নিজের উপার্জনে কেনা প্রথম বাইকও জীবনে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়! ছেলেদের কাছে। অনেক স্বপ্ন,অনেক সুখ-দুখের স্মৃতি জড়িয়ে থাকে এর চাকায় চাকায়। কখনো প্রিয় বন্ধুদের সাথে শহর তোলপার,কখনো প্রেমিকাকে প্রথম বাইকে বসানোর গর্বিত হাসি,কখনবা মাঝরাতে শ্মশানে প্রিয়জনকে শেষ বিদায় দিয়ে,বুকে শুন্য রাজপথ….লেগে থাকে এর ধাতব নিশ্বাসে।
সেই দিন ছিল শনিবার, বিদ্যালয়ে অর্ধদিবস। ছুটির ঘন্টা পড়বার সাথে সাথেই, মেঘের শঙখ নাদ জানান দিল, বৃষ্টি-সুন্দরীর আগমনের বেশি দেরী নেই। বর্ষাতি গায়ে চাপিয়ে,অ্যাকসিলেটর এ মোচড় দিতে দিতেই দেখে নিয়েছিলাম, আকাশ জুড়ে বিছানো ঘন কালো মেঘের শামিয়ানা। প্রথমে বেশ কিছুটা পথ ঝিরঝিরানি জলেই কাটালাম,এমন বৃষ্টিতে আমার বাইক চালাতে দারুন লাগে। নিস্তব্ধ ভেজা রাস্তা, ঝাঁপ ফেলা বন্ধ দোকান-পাট, একাকি শহর…..শুধু আমিই যেন এক ক্লান্তিহিন প্রান। ছুঁচের মতো বৃষ্টি ফোঁটা চিবুক বিঁধিয়ে নামতে থাকে, বুক গড়িয়ে, আরও গভীরে….. আরও গভীরে….আমার সারা শরীর শিরশির করে, বহুদিন পর প্রেমিকাকে আলিঙ্গনপিষ্ট করার সময়কার শিরশিরানির মতো। নিজের অজান্তেই সাইড মিররে, জল-রেখায় ফুটে ওঠে, হলুদ মসলিন রঙা একটা মুখ, পদ্মমণির মতো একজোড়া চোখ….কল্পনায় অনুভব করি,দুটি সুডৌল হাত সাপিনির মতো জড়িয়ে আছে আমার শিক্ত দেহ। আমার নেশা জাগে রক্তে।
সেই দিন নেশার ঘোর কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, মেঘ ভাঙা বৃষ্টি। সামনেকার রাস্তা আবছায়া কুয়াশার মতো দৃশ্যমান। আমি গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে,গতি কমিয়ে চলতে থাকি। শুধু বুনো মোষের মতো গর্জন করতে করতে মাঝে মাঝে ট্রাক বা বাস পাশ দিয়ে যাবার সময় যেন জানান দিয়ে যাচ্ছিল তাদের ক্ষমতা-দম্ভ। পথে জাতীয় সড়কে ওঠার কিছুটা আগে একটা অন্ধ বাঁক পরে। তার খানিকটা আগে, পিছন থেকে ঘন ঘন বিরক্তিকর হর্নের শব্দটা, বৃষ্টি সুরকে খান খান করে দিচ্ছিল । সাইড মিররে দেখি বিপদজনক গতিতে একটা লরি, রাস্তার বুক চিরে এগিয়ে আসছে। রাস্তা ফাঁকাই, তাও প্রায় ধার ঘেঁসে গেলাম।কারন এই আবহাওয়াই অনেক চালকই রঙিন জলের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। আশংকা যে অমূলক ছিলনা, তা বোঝা গেল কিছুটা পরেই।
হঠাৎ পিছনে ব্রেক কষার গগনভেদী আর্তনাদ,অশনি আশংকায় কেঁপে উঠলাম মুহুর্তেই। ঘাড় ঘোরাতেই দেখি, মাত্র ৩০ ফুট ব্যবধানে, নিয়ন্ত্রণহিন সেই লৌহশকট “মৃত্যু” রুপে এগিয়ে আসছে…কাছে….আরো কাছে….হেডলাইটের তীব্র আলোয় চোখ প্রায় অন্ধ। বৃষ্টির শব্দ, ইঞ্জিনের হুংকার ছাপিয়ে,শুনতে পাচ্ছি বুকের ভিতরের দামামা, প্রতি নিশ্বাস ফেলার শব্দ….মস্তিষ্ক তখন শূন্য, দেহ প্রস্তুত সমর্পিত হতে,মন তবুও আঁকরে ধরে বাঁচতে চাইছে পলক ফেলার সময়টুকুও…..
আধো ঘোরে শুধু শুনতে পেলাম, ড্রাইভারের কেবিনে খালাসির কন্ঠ, “গাড্ডী ঘুমাও…. মর্ জায়গা…. মর্ জায়গা….” লড়ির আবছা কাচের মধ্যে দিয়েও দেখতে পেলাম ড্রাইভার স্টিয়ারিং হাতে আপ্রাণ চেষ্টায় ডানদিকে প্রায় ঝুঁকে। ঘাড় ভাঙা জন্তুর মত,একচুল দূরত্বে শরীরে উষ্ণ মৃত্যুর নিঃশ্বাস ফেলে, লড়িটা আমার নিস্তার দিয়ে কিছুটা এগোতেই…….হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে একটা বাইক উল্কার গতিতে…. লড়ির সামনাসামনি।
একসাথে হাজারটা কাচভাঙার ঝনঝনানি শব্দে কেঁপে উঠল চারিদিক। ক্যারামের ঘুটির মতো বাইকটা ছিটকে গেল, ডানদিকে রাস্তার ধারে। বাইক আরোহীর শরীরটা প্রায় হাত কুড়ি দূরে রাস্তায় কয়েকবার আছাড় খেয়ে স্থির হয়ে গেল।
আশ্চর্যর বিষয়, মন্ত্রচালিতর মতো তখনও বাইকটা আমি চালিয়ে যাচ্ছি! ডানদিকের পা টা থরথর করে কেঁপে চলেছে, break shoe এর উপরে!
কোনক্রমে ধার ঘেঁষে বাইকটা স্ট্যান্ড করে ছুটে গেলাম রাস্তায় পড়ে থাকা আরোহীর দিকে। লড়িটি ততক্ষণে সুযোগ বুঝে দ্রুত অন্তর্হিত।
হেলমেট বিহীন নীল রং এর শার্ট পরা দেহটা রাস্তার ধার ঘেঁষে পড়ে আছে। ঠিক যেন পাশ ফিরে ঘুমানোর ভঙ্গিমায়। পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে চিৎ করে দিতেই দেখি, অল্প বয়সী ছেলেটি হয়তো আমারই মতো বয়সী। ক্ষত বিক্ষত মুখ। নাক, কান,মুখ দিয়ে ভলকে ভলকে বেরনো রক্তে, মুহূর্তেই কালো পিচের রাস্তা লাল হয়ে উঠল। ছেলেটার জ্ঞান তখনো আছে। ডান হাতটা সে আমার দিকে তুললো। আমি তার হাতটা চেপে ধরলাম, ওকে আশ্বস্ত করতে যে ও একা নয়।
এরপর শুধু কয়েক পলক মুহূর্ত। বয়ে চলা রক্তস্রোতের সাথে প্রাণশক্তির এক অসম যুদ্ধ। ছেলেটার পুরো শরীর থর থর করে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাঁপতে লাগল। কিছুক্ষণ পর হেঁচকির পর হেঁচকি….. তারপর বিস্ময় ও আকুতি ভরা চোখের মণি দুটি স্থির, ঘাড়টা হেলে পড়ল একপাশে।
পাশে পড়ে থাকা ছেলেটার ব্যাগ থেকে দেখলাম, উঁকি দিচ্ছে একটা গোলাপ ফুলের তোড়া। এই বয়সে,এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার কথা ছিল কি ওর? হয়ত এই ফুলের তোড়াটির জন্য অপেক্ষা করছে কোনো নারী….হয়তো এই বছরই ছেলেটির বাবা মা কে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল বেড়াতে….. হয়তো….। একটা বয়সের পর আন্তরিক ভাবে আর কাঁদা যায়না আমিও পারলাম না।নিঝুম সড়কের একাকী নিঃসঙ্গতায় আমিই তখন চেপে ধরে আছি ছেলেটির শিথিল হাত।
আস্তে আস্তে মুঠো খুলেই দেখতে পেলাম ওর আয়ু রেখা। চওড়া কব্জির ওপর সুগঠিত তালুতে নদীর মতো বিস্তৃত আয়ুরেখা,আমার আয়ুরেখার চাইতে অনেক দীর্ঘতর। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। অলীক আলোয় চারিদিক ফ্যাকাসে, ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে ছেলেটির হাতের বিপত্তারিণীর তাগার লালটুকুও….