সকাল থেকে সুরমার মাথা ধরে আছে।কত কাজ , কী করে একা হাতে সব সামলাবে কে জানে ! বাড়ি ভর্তি লোক ,তাদের জলখাবারের ব্যবস্থা করা , পুলুর গায়ে হলুদের সমস্ত জোগার করা, সব দায়িত্ব সুরমার । সুদেব শুধু চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বাড়ি মাত করবে আর ফোড়ন কাটবে , এটা হল না , ওটা হল না , ব্যস তার কাজ শেষ। সেই বিয়ের পর থেকে আজ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে দেখে আসছে , লোকটা একটুও পাল্টালো না।কোনও কাজই দায়িত্ব নিয়ে একা করতে পারে না , শুধু ছাত্র পড়ান ছাড়া ।পাড়ার নাম করা অঙ্কের শিক্ষক।ছাত্রদের কাছে তো দেবতা প্রায় ! স্যারের একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা । সব কিছু বাড়ি বসে হয়ে গেছে। শুধু উনি পুরান ডাইরি খুঁজে খুঁজে সবার ফোন নম্বর জোগার করেছেন। ছেলেও হয়েছে বাবার মতন ।সব দায় দায়িত্ব মায়ের কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারলে বাঁচে।দেখতেও যেন যৌবনের সুদেব , শুধু রঙটা একটু মাটো।পুলুর মুখে এক কথা , সুরমা ব্যানার্জির বয়স চল্লিশেই আটকে গেছে, আর বাড়েনি ,তারসাথে নাকি অফুরন্ত প্রাণ শক্তি ওর মায়ের ।ষাট বছর বয়স হল , শরীর আর দিচ্ছে না , তাইতো পুলুর তেমন ইচ্ছে না থাকলেও ইজ্ঞিনিয়ারিং করে চাকরি পাবার সাথে সাথেই বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল সুরমা। ভারি মিষ্টি মেয়ে পাখি , এম এ করছে বাংলায়।বিয়ের পরও পড়াশোনা করবে বলেছে ।শিক্ষকতা করার ইচ্ছা তার , সুরমা তাতে খুব খুশি , মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানটা খুব দরকার। এখনও সুরমা গানের ক্লাস করায় ।শুধু টাকার দরকারে কাজ করা নয়, মনটা ভাল রাখার জন্য কাজ করাটা খুব জরুরি আর একটা জিনিস, সম্মান , যে মেয়ে নিজের দরকারের টাকার জন্য অন্যের সামনে হাত পাতে না , তার সম্মান সব সময় বেশি।তাই সুরমার ব্যক্তিগত ধারনা , প্রত্যেক মেয়ের উচিত নিজের নিজের সামর্থ মতো কিছু করা।
এত কাজের মধ্যেও সব পুরান কথা মনে পরে যাচ্ছে ওর।বাচ্ছা বড্ড ভালবাসত সুরমা, যখন নিজে ছোট ছিল, তখনও ছোট্ট বাচ্ছা দেখলেই কোলে নিতে যেত। ওর সম বয়সি বন্ধুদের সাথে খেলার থেকে বাচ্ছাদের সাথে খেলা ওর পছন্দ ছিল।প্রেম করে বিয়ে করেছিল সুদেব আর সুরমা । বিয়ের পরপরই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাচ্ছা নেবার ।কিন্তু হায়! বিধার ইচ্ছার কাছে মানুষ কত অসহায়। ভাগ্য এত প্রসন্ন ছিল না ওদের । বিয়ের দু বছরের মাথায়ও সন্তান সুখ না পেয়ে সুরমা পুরো বিভ্রান্ত । ছোটখাট খুঁটিনাটি কথায় রাগারাগী চলতে লাগল দুজন ভালবাসার মানুষের মধ্যে।তার মধ্যে সুদেবের মা আবার ঘৃতাহুতি দিত, নাতির মুখ দেখা , নাতির মুখ দেখা করে করে। একেই সুরমার নিজের মনকষ্ট তার ওপর বংশ রক্ষার প্রবল চাপ শ্বাশুড়িমার থেকে। কান্না তখন নিত্য সঙ্গী ছিল সুরমার জীবনে। কত যে ডাক্তার দেখিয়েছে নিজেই হিসেব ভুলে গেছে । যে যখন যেই ডাক্তার বলত ছুটে যেত দেখাতে ।কত রকমের চিকিৎসা চলেছে ওর শরীরের ওপর দিয়ে ।দুবেলা করে ইজ্ঞেকশন ফুটিয়েছে কোমরে , দাঁতে দাঁত কামরিয়ে সব কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করেছে শুধু একটি সন্তানের আশায়। কিন্তু সবাই শুধু আশার আলোই দেখিয়েছে , কোল আলো করে একটা সন্তান আর কোন ডাক্তার দিতে পারেনি । আশায় আশায় দশটা বছর কখন কেটে গেছে । এতকিছু করে যখন সন্তান এল না , তখন সুরমা দত্তক সন্তানের কথা ভাবতে শুরু করল।সুদেব তো চিকিত্সা শুরুর সময় থেকেই বারবার ওকে বলে আসছে , পৃথিবীতে কত কত শিশু বিনা মা বাবার স্নেহে বড় হচ্ছে , তাদের মধ্যে থেকেই কাউকে আপন করে সন্তান সুখ পাই । কিন্তু সুরমার কেন যেন এটাকে পরাজয় মনে হত।শ্বশুর শ্বাশুরির কাছে নিজেকে খুব হারমানা সৈনিক মনে হত। ঐ যে সব সময় বংশ রক্ষার কথা ওদের মুখে ঘুরত , সেটাই সুরমার মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে দত্তক নেবার সিদ্ধান্তের কথা সুদেবের বাবা মাকে জানিয়ে ফেলল। ব্যাস , যে টুকু শান্তি সুরমার জীবনে ছিল , সব জলাঙ্জলি গেল।তুমুল অশান্তি শুরু করল সুদেবের মা বাবা দুজনে মিলে । ওদের যুক্তি বাচ্ছার শরীরে কোন রক্ত বইছে , কোন ধর্মের কিছুই তো জানা যাবে না । ব্রাক্ষ্মণ বংশে যদি মুসলমান কোন বাচ্ছা চলে আসে , তবে সাত পুরুষও ওদের ক্ষমা করবে না ।অযৌক্তিক কথাবার্তার মাঝে কী যে যুক্তি দেখাবে আর কী ভাবেই বোঝাবে কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না সুরমা । এরমধ্যেই একদিন বাড়িতে না জানিয়ে বর বউতে মিলে মিশনারি অফ চ্যারিটিতে ঘুরে দরখাস্ত করে এসেছে ।বছর দুই অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিছে চ্যারিটি , প্রচুর নাকি দরখাস্ত জমা পরেছে ।নিজের এত সমব্যাথি আছে জেনে আসার পর মনে যেন খুব জোর পেয়েছে । সুরমা তখন মনে হচ্ছিল যা হয় হবে ও দত্তক নেবেই, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ।
সত্যি বছর দুই পর সুখবরটা পেল সুরমা চিঠির মাধ্যমে ।চিঠি পাবার পর থেকে বাচ্ছা আনতে যাওয়া পর্যন্ত সময় টুকু যেন প্রসব যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিল সুরমা ।সুদেবের পৈত্রিক ভিটে ছাড়তে হয়ছিল । ওরা ওদের সন্তানকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে চলে গেছিল । মাতৃত্বের প্রতিটা মূহুর্ত উপভোগ করছিল । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সুদেবের সবচাইতে প্রিয় নায়ক , তাই ওনার ডাকনাম ও ভালনাম দুটোই দিয়েছিল নিজের ছেলেকে ।এতবছর পর এত সুখ পেয়েছে সুরমা , মাতৃত্বের স্বাদ প্রতিক্ষনে চেটেপুটে নিচ্ছে, তাও নিজেকে অপরাধী মনে হয়। মনে হয় ওর জন্যই আরেক মা সন্তানের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
একদিন পুলুকে নিয়েগিয়ে চুপিচুপি শ্বাশুরির ঘরে রেখে দিয়ে দূর থেকে নজর রাখছিল। ওর বিশ্বাস ছিল ফুটফুটে একটা বাচ্ছাকে দেখে মা কিছুতেই মুখ ফেরাতে পারবে না । হলও তাই। ঠাকুমা আর নাতিতে মিলে খুব খেলা ধূলো করল সারাদিন ধরে । তারপর আর রাগের অভিমানের জায়গাই থাকে না । ওরা আবার সবাই মিলে থাকতে শুরু করল । ঠাকুমা আর দাদু তো পুলুকে চোখে হারাত । দুজনেই নাতির হাতে জল খেয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে ।
কত কথাই না সুরমার মনে পরে যাচ্ছে আজকে । ভাগ্যিস জোড় করে ছেলে সন্তান দিয়েছিল চ্যারিটি থেকে , ওদের মেয়ের খুব শখ ছিল , মেয়ে হলে তো চলে যেত ওদের সন্তান শ্বশুরবাড়ি, তার জায়গায় আজ থেকে জোড়া সন্তান পেয়ে যাচ্ছে সুরমা । নিজের সুখে নিজেরই না নজর লেগে যায় ভেবে কড়ে আঙুলটা একটু এঁটো করে নিল পুলু আর পাখির মা ।