“ও, তোমার সেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা পিওন- সেই বান্ধবী, ওঃ তুমি পারও বটে জোটাতে”। ব্যাঙ্গ ভাবে কথাগুলো বলে অপাঙ্গে দ্যুতির দিকে তাকিয়ে অনি সিগারেট ধরাল।দ্যুতি ভাবলেশহীন মুখে বাঁ কানে নতুন কেনা দুলটা পড়তে পড়তে শান্ত স্বরে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ, আমার সাধারণ বান্ধবী পিওন”। বাসে, অটো ও মেট্রো তে যাতায়াত করে আমি যে কত সমৃদ্ধ হয়েছি – কত যে সাধারণ মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে, ভালো লাগে আমার, আমি কৃতজ্ঞ যে তোমার গাড়ী আর আমায় অফিসে নামায় না।
দ্যুতির এই শান্ত উত্তরে অনি বেশ অবাক হল। খবরের কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে প্রত্যুত্তর দিলো, – হুঃ, ভিড় ঠেলে, গরমে দাঁড়িয়ে থেকে অফিস যেতে তুমি তাহলে এনজয় করো, তাই তো?strange!”
দ্যুতি কোন উত্তর না দিয়ে, ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে পারফিউম স্প্রে করে মা-বাবার ছবিতে নমস্কার করে চপ্পলটায় পা গলাল, বাস ধরতে আর মিনিট পাঁচেক বাকি। অবশ্য অনি নামিয়ে দেয়।
বাসে উঠেই বাসন্তীর সাথে দেখা। বয়স হবে, এই মধ্য চল্লিশ। ছাপা শাড়ি ও ম্যাচিং ব্লাউস আঁটোসাটো করে শরীরে জড়ানো, শক্তপোক্ত দোহারা চেহারা। চকচকে কালো চুলে খোঁপা করা। কাঁধে সস্তার চিনে ব্যাগ, দু হাতে নকল সোনার বালা। কিন্তু তার মুখের ঝকমকে হাসিটা আর চকচকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটো একেবারে আসল।
দ্যুতির জন্য সে রোজ সিট রেখে দেয়। কত সে গল্প করে। তার ঘর-সংসারের ছোটখাটো নিত্য দিনের সমস্যা, আনন্দ সবই ভাগ করে নেয় দ্যুতির সাথে। ঘরে আছে তার স্বল্পশিক্ষিত ছেলে, ছেলেমানুষ বউমা আর একরত্তি এক নাতি। ছেলে কাজ করে স্থানীয় এক বিস্কুট কারখানায়, ১০০ টাকা রোজে। কামাই হলে মাইনে পায় না। মুলতঃ ওরই রোজগারে সংসার চলে। সম্প্রতি দুটো ঘর পাকা করেছে সিমেন্ট দিয়ে, বারান্দা করে একদিকে রান্না করার ব্যাবস্থা করেছে। তবে জলকল প্রতিবেশীদের সাথে ভাগ করা।
দ্যুতি গল্প করতে করতে প্রায় প্রতিদিনই জিজ্ঞাসা করে ওর হেঁসেলের কথা। নিম্ন মধ্যবিত্তদের তুলনায় ভালই মেনু থাকে; শাক ভাজা, চচ্চড়ি, মাছের ঝাল থেকে দিনে চিলি চিকেন ও ফ্রাইড রাইস অব্দি। দ্যুতি মজা পায়, ভাবে চিনারা ভাবতে পারবে, কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তাদের রন্ধন শিল্প! ভাজা মশলা তৈরি করে দ্যুতিকে রোজ দেয়, সেই মশলা এককথায় অতুলনীয়।
বাসন্তী একদিন দ্যুতিকে চা খেতে নেমন্তন্ন করল ও সদ্য বানানো তার নতুন বাড়ীতে। দ্যুতির সহজ সরল অমায়িক বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারে বাসন্তীর একবারও মনে হয় নি তাদের বাড়ীর লাগোয়া ঝাঁ চকচকে বাতানুকূল যন্ত্র বসানো আধুনিক ফ্ল্যাটবাড়ীর লোকেরা দাম্ভিক হয়।
এক শনিবারের বিকেলে দ্যুতি হাজির হল বাসন্তীর বাড়ী। অনেকগুলো খুপড়ি ঘর পেরিয়ে এল বাসন্তীর নতুন সাদা রঙ করা দুই কামড়ার বাসায়, ঢোকার মুখে ছোট্ট বাঁশের গেট, ছেলে সদ্য সবুজ রঙ করাতে, সামান্য কাঁচা আছে। গেট ঠেলে ঢুকতেই চোখটা জুড়িয়ে গেল। ছোট্ট উঠোনের একপাশে মাচাতে ঝুলছে লকলকে লাউডগা, কয়েকটা কচি লাউও ঝুলে আছে, তার ধার ঘেঁসে কচি সবুজ লঙ্কা উঁকি মারছে, আরেকদিকে তুলসীমঞ্চ, একটা ঝাঁকড়া জবা গাছ, অনেক পঞ্চকেশর জবা নিয়ে আলো করে আছে জায়গাটা, সামনে চকচকে লাল সিমেন্টের বসার জায়গা। পাশাপাশি দুটো ঘর। রুচিপূর্ণ ছাপা পর্দা ঝুলছে। পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকতেই মনটা ভালো হয়ে গেল দ্যুতির। পরিপাটি করে রাখা আছে সামান্য আসবাবপত্র। চোখ এড়ালো না, সামনের টেবিলে পাতা সূক্ষ কাজ করা টেবিলক্লথটা। আরও চমৎকৃত হল, ঝকঝকে কাঁসার গেলাসে রাখা কচি কটা সবুজ পাতা। বাসন্তীর রুচি আছে। বাসন্তীর ছিপছিপে শ্যামলা বৌমা বেরিয়ে এল তার কাজল পড়া দুটো চোখে অভ্যর্থনা জানিয়ে, কোলে তার পুঁচকে ছেলেকে নিয়ে। ছোট্ট লাল জামা ও ‘হাগিস’ পড়া বাচ্চাটা দিব্যি দ্যুতির কোলে চলে এসে সামটে ধরল দ্যুতির আনা তুলোর কুকুরটা। বাসন্তীর বউমাকে দ্যুতি দিলো একটা সুন্দর হাতব্যাগ। উপহারগুলো পেয়ে ওরা যেন অভিভূত হয়ে গেল। নানান খুচখাচ গল্প করতে করতে হাঁসের ডিমের উপাদেয় অমলেট ও গরমাগরম বাড়ীতে ভাজা বেগুনী খেল লাল চায়ের সাথে। ততক্ষনে চারদিক থেকে ঘর গেরস্থালীর নানা আওয়াজ ও শাঁখের মঙ্গল আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে, বৌমা কিছুটা ধুনো ছড়িয়ে গেল। দ্যুতির মনটা নিমেষে আরও তরল, আরও ভালো হয়ে গেল।
বাসন্তী দ্যুতিকে এগিয়ে দিতে বেড়িয়ে পড়ল। তারপর আসতে আসতে তার জীবনকথা শোনালো। বিয়ের পরপরেই অন্তঃসত্বা হয়েই বুঝেছিল স্বামীর সাথে ওর জা এর অন্য সম্পর্ক আছে, একদিন ওদের আপত্তিজনক অবস্থায় দেখে আর মনঃস্থির করতে সময় নেয় নি বাসন্তী। এক কাপড়ে মা-বাবার কাছে চলে এসেছিল। ভাগ্যক্রমে ওরাও বাসন্তীকে সাদরে গ্রহন করেছিলেন। বাপের বাড়ীতে ছেলের জন্মদিনে বাসন্তী এক ওকে ধরে, হাজার দৌড়ঝাঁপ করে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিওনের এই স্থায়ী চাকরীটা অর্জন করে। দৃঢ়চেতা মেয়ের জন্য বাবা-মা নিজেরদের বাড়ীর পাশে পরে থাকা জমিটায় ঘর তুলে ওর নামে লিখে দিয়েছিল। পারা-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন ওর ব্যাক্তিত্ব দেখে আর কিছু বলার সুযোগ পায় নি। বাসন্তী সেই একফোঁটা ছেলেকে বাবা-মা ইয়ের সাহায্যে বড় করল, লেখাপড়ার তেমন মাথা ছিল না, কোনোরকমে মাধ্যমিক পাশ করল। পরিবারের লোকেরা হা-হুতাশ করে কপাল চাপড়াল, কিন্তু বাসন্তী একফোঁটাও ভেঙ্গে পড়ে নি, মনোবল হারায় নি। ওর তো পাকা সরকারী কাজটা আছে। একে ওকে ধরে ছেলেকে বিস্কুট কারখানায় ঢুকিয়ে দিলো। কালক্রমে সেই ছেলের বিয়ে দিলো এক কর্মঠ, বুদ্ধিমতী মেয়ের সাথে, সে তাকে মানবে, খাটবে, সবাইকে যত্ন করবে ও নিজেও সসম্মানে বাঁচবে। আজ তার ছেলে তার কাছে ১০ হাজার টাকার মোবাইল ফোন আবদার করে, বাসন্তী চেস্টা করছে সেই আবদার মেটাতে। বাসন্তী আজ প্রকৃত অর্থে সুখী। ওর জীবনের নেতিবাচক দিকটাই ওকে আজ সাফল্য এনে দিয়েছে- টা যতই সামান্য হোক অন্যের চোখে। ওর নিজস্ব ছোট্ট জগতে সবাই ওকে সমীহ করে, ভালবাসে।
দ্যুতি সব শুনে ওর হাতে চাপ দিয়ে বলল, “তুমি খুব সাহসী। You are a brave lady. চালিয়ে যাও তোমার জীবন সুন্দর ভাবে। Keep it up!” বাসন্তীর চোখে জল। দ্যুতির হঠাত অনির জন্য কষ্ট হল, “বেচারা জানতে পারল না, অন্যের হৃদয় ছুঁতে জানলে, কত আনন্দ পাওয়া যায়”।