অফিস ফেরত বাজার করে নিয়ে এসেই আমার দায়িত্ব শেষ – বাদবাকিটা মা-ই সামলে নেয়। আমার তখন পুরোটাই “মী টাইম”; বই পড়ি, ম্যাগাজিন পড়ি, ইউটিউব খুলে পছন্দমত ভিডিও দেখি, মাঝে মাঝে অনেকদিন না কথা হওয়া বন্ধুগুলোকে ফোন করি…সময়টা বেশ ভালই কাটে। আমি আর মা রাতে একসাথে খাই, সেইসময়টাতেই আমার টিভির সাথে যা সম্পর্ক- তারপর নিশ্চিন্তের ঘুম। এইরকম বেশ ছকে বাঁধা একটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন ছিল আমার। ইদানীং, মানে মাস চারেক, বড্ড বেশী ভাবছি, হ্যাঁ; ভাবনাটা বেশ বেশী রকমই হচ্ছে…আর একটা বেশ রোমাঞ্চকর ভালোলাগা চোরাপথে মনের ভেতরে প্রবেশ করেছে।
বছর পাঁচেক হল পৌষালী মিমিকে নিয়ে চলে গেছে। মহামান্য আদালতের সহৃদয়তায় মাসে একবার মিমিকে দেখি-মানে দেখতে যাই বা দেখতে পাই, ঐ আর কি! পৌ-এর জন্য আমার মনে আর একচুলও রাগ-অভিমান-দুঃখ নেই। ওকে মোহিতের সাথে ভালো থাকতে দেখে, ভালই লাগে; মিমির নতুন বাবা, আমার থেকে অনেক ভালো….. বেশ হাল্কা আমি।
****************************************
নতুন চাকরীটা খানিক না চাইতেই পাওয়া। আমি নিজেই জানতাম না, আমার দ্বারা জনগণকে ট্রেনিং দেওয়া সম্ভব। আদ্যান্ত সেলস-এর লোক আমি, নিজেকে ‘বেচুবাবু’ ভাবতেই ভালবাসতাম। টার্গেট আ্যচিভ করলেই পদন্নতি-বেশ মজা লাগত। ইন্সেন্টিভ পাওয়াটা আমার কাছে একটা গেম উইনিং এর মতন ছিল – একেকটা টার্গেট যেন একেকটা রাউন্ড জেতা!
পৌ ছেড়ে চলে যাবার পর এই জেতার লড়াইয়ে একটা মন্দা এসেছিল। পুরুষ মানুষের কাছে বউ-বাচ্চা ছেড়ে চলে যাওয়াটা একরকমের সামাজিক পদাবনতি। প্রায় একঘরে করে নিয়েছিলাম নিজেকে, বাড়ি থেকে বেরোলেই পৌএর নিন্দা শুনতে হত, মোটেই ভালো লাগত না। সিদ্ধান্তটা অনেক ভেবে আমরা দুজনে মিলেই নিয়েছিলাম। সবাইকে কি করে বোঝাতাম, আমার আর পৌ এর মধ্যে শুধু সামাজিকতাই বজায় ছিল, দুজনে ছিলাম দুটো অন্য মানুষ। বিয়ের পরে বুঝতে পেরেছি….আমার জীবন দেখা আর ওর জীবন দেখার মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ, নিজেরা কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মিমিকে আনার..যদি অবস্থা শুধরায়; কিন্তু মিমির সাথে মোহিতও এসে গেল আমাদের মাঝে। আমার জোর খাটে নি। আজও মন থেকে চাই পৌ ভালো থাকুক।
শুরু করেছিলাম মেডিটেশান, সেই ক্লাসেই আলাপ অতীনদার সাথে। এই অতীনদাই আমায় জোর করে চাকরীটা ছাড়াল আর নিয়ে এল “জিন্দেগী” তে। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার নতুন কোম্পানির নাম “জিন্দেগী” আর আমি হলাম এখানকার ‘লাইফ সাকসেস ট্রেনার’।
****************************************
এই অতীনদা লোকটা আমার জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করছে। লোকটা যেন সাক্ষাৎ এক ‘মুশকিল আসান’। যেকোনোও সমস্যাই যখন দাদার সাথে সেয়ার করতাম, মনে হত; এ আবার কোনও প্রব্লেম নাকি!
শাল্মলী আর উষ্ণীষ এর সাথে আমাকে আলাপ করানো হয় ‘একজন লাইফ চ্যাম্পিয়ান’ বলে। অতীনদা এই কাণ্ডটা ঘটিয়েছিল; ভীষণ অপ্রস্তুত লাগছিল নিজেকে। আমার সেলস প্রফেশন নিয়ে বললে মানতে পারতাম…..
আমাকে কোনও ইন্টার্ভিউ দিতে হল না। একমাসের নোটিশ পিরিয়ড সার্ভ করেই জয়েন করে নিয়েছিলাম “জিন্দেগী”। রোজগারের জায়গাটা কম্প্রোমাইস করতে দু বার ভাবতে হয় নি; শাল্মলী আর উষ্ণীষ – এদের দুজনের আমার উপর আস্থাটা অনেক বড় লেগেছিল।
আমার প্রথম আ্যসাইনমেন্ট ছিল একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ট্রেনিং, বেশ মজা লাগছিলো, আমি নিজে যে ভাবে নিজেকে মোটিভেট করতাম টার্গেট আ্যচিভ এর জন্য, সেই গল্পগুলোই অনায়াসে বলে ফেললাম…. লোকে তালি দিল, জড়িয়ে ধরল, আলাদা করে কথা বলার জন্য ফোন নম্বর নিল- তাজ্জব! নিজে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না…. আমার এই ক্ষমতা কিন্তু আমি বুঝতেই পারি নি। ধন্যবাদ অতীনদা।
আমার সাথে বেশি কথা হয় উষ্ণীষের। শাল্মলী কন্টেন্ট ডিসাইনিংটা দেখে আর যাবতীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই হল ওর কাজ, সেই নিয়ে ব্লগ লেখা, ক্যাম্পেন করা….আর উষ্ণীষ মার্কেটিংএর দায়িত্বে। জয়েন করার এক সপ্তাহের মধ্যে এই আ্যসাইনমেন্টটা আসে, একটু ঘাবড়েছিলাম বই কি।
বিদেশে ম্যানেজমেন্টের দামি চাকরি ছেড়ে শাল্মলীর সাথে নতুন ভেঞ্চার শুরু করেছে উষ্ণীষ। শাল্মলী তার বোনের বন্ধু। সুপুরুষ, অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, অসম্ভব ভালো কথা বলে ….. উষ্ণীষকে প্রথমবার দেখেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। শাল্মলী ভীষণ অন্যরকম একজন, স্মোক করে, গাড়ি চালায়, রাত ১২টাতেও গাড়ি চালিয়ে বাড়ি যেতে ভয় পায় না…. অনায়াসে গালাগালি দেয়। উষ্ণীষের সাথে বহুদিন রাত কাটায়।প্রথমদিকে ওদের দুজনকে দেখে খুব মনে হত, ওদের মধ্যে কাজের বাইরেও একটা সম্পর্ক আছে। উষ্ণীষের লিভ-ইন পার্টনার আদিলের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর, ধারনাটা বদলেছে।
*************************************
সেদিন শাল্মলী আমায় ওয়েট করতে বলল, এর আগে একদিন ওর সাথে আমি নিজেকে নিয়ে কথা বলছিলাম…আমি চট করে বলি না নিজের কথা, কিন্তু প্রসঙ্গটা একাকীত্ব নিয়ে ছিল তাই কথায় কথায় নিজের কথা বলা শুরু করেছিলাম। বাড়ি আসার পথে আমাদের দুজনের কনভারসেশান গুলো মনে করতে করতে বুঝতে পারছিলাম, মেয়েটাও কোনোভাবে একা …. অন্যের জীবন নিয়ে ঔৎসুক্যটা আমার একেবারেই নেই … ভাবনাটা এসেই মিলিয়ে গিয়েছিল।
ঘড়ির কাঁটা ১০টার দিকে এগোচ্ছে। মা কে আগেই ফোন করে দিয়েছি দেরী হবে জানিয়ে। পরের সপ্তাহে একটা বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে প্রেসেন্টেশান দেওয়ার আছে, সেই নিয়েই সবাই ব্যাস্ত। প্রজেক্টটা আসলে প্রায় এক বছর ধরে চলবে। “জিন্দেগী”র একটা মাইলস্টোন হতে পারে। বসে বসে ভাবছিলাম সেই প্রোজেক্টের কথা।
হঠাত সজোরে দরজা খুলে প্রবেশ করল শাল্মলী। একঝলক ভদকার গন্ধ পেলাম যেন….ব্যাগটা রেখে শশব্যস্ত হয়ে টেবিলের ড্রয়ার খুলে কি যেন খুঁজতে শুরু করল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, একবার জিজ্ঞেস করলাম….আগে কথাটা বলে নি? কোনও উত্তর নেই।
সন্তোষপুরে একটা বাড়ির একতলা ভাড়া নিয়ে এই অফিস। অফিসের এই রুমটায় শাল্মলী আর উষ্ণীষ বসে, পাশের ঘরটায় আমি। আজ আমায় শাল্মলী ওর রুমেই ওয়েট করতে বলেছিল। শাল্মলীর এই অদ্ভুত আচরন আমায় নিজেকে বড় বেশি জড়তাযুক্ত করে তুলছে।
ডু ইউ নো, আমি কেন ওয়েট করতে বলেছি? শাল্মলী আমার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে,
- অবভিয়াস্লি, এই প্রোজেক্ট ডিসকাস করতে। আমি উত্তর দিলাম।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, শাল্মলী একটু দূরে দাঁড়িয়ে ….. দুটো হাত ছড়িয়ে …….
আমি জানি না, কোন মন্ত্রবলে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে ধরা দিলাম নিজেকে সেই বাহুপাশে …….
****************************************
তারপর…… তারপর সবকিছুই আগের মতন …..শুধু “জিন্দেগী” কে একটু বেশী ভালো লাগছে ….. আর, ভাবনাটা একটু বেড়েছে।