__ হাতের মেহেন্দির রঙ এখোন ও তৃষার হাত থেকে মলিন হয় নি — দীপ্ত বেশীদিন ছুটি না পাওয়ায় বিয়ের পনের দিন এর মাথায় USA ফিরে গেছে । তৃষার ভিসা রেডি হয়নি – তারপর স্কুলের চাকরী ছাড়বো বললেই তো ছাড়া যায় না । তাই ঠিক হয়েছে মাস তিনেক পর ও একাই এ দেশের পাততাড়ি গুটিয়ে পাড়ি দেবে দীপ্তর কাছে নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে । আর তাছাড়া এদেশে আছেই বা কে — মা – বাবা অনেক দিন আগেই গত হয়েছেন — একমাত্র ভাই তার পরিবারের সাথে কোলকাতায় সেটল ।
আজ বুদ্ধ পূর্ণিমা – তাই তৃষার স্কুল ছুটি ছিল । বেশ লম্বা একটা ভাত ঘুম দিয়ে তৃষা কফি বানাতে রান্নাঘরে ঢুকতে যাবে — এমন সময় মোবাইল টা বেজে উঠলো ।বলা বাহুল্য তৃষা লোনাভেলার একটা স্কুলের টিচার এবং একরুমের একটা Flat এ একাই থাকে ।
অপর প্রান্তে নতুন জীবন সাথী দীপ্তর গলা শুনে তৃষা আপ্লুত — আবেগ তাড়িত গলায় কত কথা — কে বলবে আর কে শুনবে – দু জনেই চায় দু জনকে শোনাতে । কতক্ষণ যে পার হয়ে গেছে কারুর সে খেয়াল নেই ।
এমন সময় ডোর বেলে তৃষা চমকে উঠল — সূর্যাস্তের সময় নিকটে — এ সময় তো কারুর আশার কথা নয় । মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল – সব সময় দীপ্তর সাথে কথা হয় না । বেশ গল্পে মশগুল ছিল – এমন সময় কে এলো বিরক্ত করতে ! অগত্যা দীপ্ত কে বাই বলে মোবাইল টা রেখে দরজার দিকে পা বাড়ায় ।
দরজা খুলতেই তৃষার পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল — দরজায় দাঁড়িয়ে দেবত্তম । বেশ কিছুদিন আগে এক সোসাল নেটওয়ার্ক সাইটে পরিচয় হয় দু- জনের ।গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধা পড়েছিল ওরা । যদিও দুজনেই একই শহরের , কিন্তু নিয়োতির খেলায় কেউ কাউকে দেখেনি কোনদিন – অথচ উভয়েই উভয়ের ঠিকানা জানত ।
হতভম্ব তৃষার সম্বিত ফিরল দেবত্তম এর গলার আওয়াজে — ” বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি ভিতরে আসতে বলবে ” — সে বলল ।দেবত্তম কে ভিতরে আসতে বলে বাইরের দরজাটা বন্ধ করল সে ।তৃষার flat এর বারান্দা টা পশ্চিম দিকে — সূর্যাস্তের লাল আভা গায়ে মেখে মোহিনী রূপ ধারণ করেছে তখন আকাশটা । একসময়ের প্রিয় বন্ধুটিকে বারান্দায় বসতে দিয়ে তৃষা কফি বানাতে রান্না ঘরে ঢোকে ।
একে একে স্মৃতিগুলো মনের দরজায় কড়াঘাত করতে থাকল তৃষার ।বন্ধুত্বের গভীরতা এতটাই ছিল যে রোজ সকালে সে ঘুম থেকে না ওঠালে দেবত্তম এর অফিস যেতে দেরী হয়ে যেত ।তৃষা রোজ সকালে স্কুল যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে ‘তাকে’ ফোন করে ডেকে তারপর নিজে বাড়ি থেকে বের হত ।সারাদিন কত কত বার ফোন —- খেয়েছো কিনা — কখন ফিরবে – শরীর ঠিক আছে কিনা আরও কত কথা । স্কুলে ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে সুযোগের সদ্ব্যবহার — কথা না থাকলেও গলাটা শুধু শোনোর জন্য ফোন ।
কফি বানিয়ে নিয়ে তৃষা গিয়ে বসল প্রিয় বন্ধুটির বিপরীতের চেয়ারটিতে ।আজ অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তার মনে — ইচ্ছে হচ্ছে এক এক করে সব প্রশ্নের উত্তর আদায় করে নিতে দেবত্তমের কাছ থেকে । কিন্তু গলা দিয়ে একটা শব্দ ও বের হচ্ছে না তার । নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে আলগা করে তৃষার হাত টা স্পর্শ করতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সে ।তবুও কোন প্রশ্ন করে উঠতে পারে না — মন চাইছে দেবত্তম কে জিজ্ঞাসা করতে কেন সে কিছু না বলে সেদিন দূরে সরে গিয়েছিল – এতো সুন্দর মধুর সম্পর্কের যবোনিকা কেন টেনে ছিল সে – কি অপরাধ করে ছিল তৃষা । কিন্তু মেয়েদের মুখ ফোটে না — তাই —
এদিকে সূর্যাস্তের পর আকাশ হালকা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আসছে – কফির শেষ চুমুক দিয়ে দেবত্তম তার ব্রিফকেস থেকে ছোট্ট একটা গিফট রাপ বের করে তৃষার হাতে দিতে তৃষা চমকে ওঠে । সম্পর্কের যবোনিকা পাতে সে তার প্রিয় বন্ধুটিকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করতে ভুলেই গিয়েছিল । তাই প্রথমটায় সে কিছুতেই উপহার নিতে রাজী হলো না । দেবত্তম তাদের সেই মধুর দিনগুলো স্মরণ রাখার উদ্দেশ্যে এই গিফট বলায় তৃষা নিতে রাজী হলো ।
ক্ষণিক তাকিয়ে থাকল নিষ্পলক চোখে একে অপরের প্রতি — দেবত্তম বলল ” এবার আমায় ফিরতে হবে — না হলে মা – বাবা চিন্তা করবেন “।
মন না চাইলেও বিদায় জানাতে এগিয়ে এলো তৃষা — আর হয়তো জীবনে কোনোদিন দেখা হবে দুজনের — যন্ত্রণায় বুকের ভিতর টা ভেঙে যেতে লাগল ।
দেবত্তম কে বিদায় জানিয়ে কান্নায় আছড়ে পড়লো তৃষা বিছানায় – ভুলে গিয়েছিল উপহারের কথা ।হঠাৎ মনে পড়তেই ছুটে যায় সে বারান্দায় – সেটা হাতে নিয়ে গভীর আবেগে ফিরে আসে ঘরে । পরম স্নেহে রাপ টা খুলতেই বেরিয়ে আসে একটা হীরের আংটি ও একটা ছোট্ট চিরকুট ।
চিরকুটে লেখা —” তৃষা আমি তোমায় ভীষণ ভালোবেসে ফেলে ছিলাম – জীবন সঙ্গীনি করার প্রপোজাল দেব ভেবে সেদিন আঙটি টা কিনে দোকান থেকে বেরোতে যাচ্ছি , হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই ।তারপর বেশ কয়েক দিন পর যখন জ্ঞান ফেরে – হসপিটালে অঙ্কলজি বিভাগের বিছানায় নিজেকে পাই ।তাই আর তোমার সাথে কোন যোগাযোগ করিনি – পারলে ক্ষমা কোরে ভুলে যেও আমায় “।
তৃষা শূন্য দৃষ্টিতে দেবত্তমের রেখে যাওয়া এঁটো কফির কাপে গভীর আবেশে চুম্বন করে — এ ছাড়া আর কি বা করার আছে তার ___