শাড়ি

আমার বন্ধুমহলে বেশ কিছু অলোকসামান্য সুন্দরী আছেন, যাঁদের শাড়ির ভাণ্ডার তাঁদের নিজেদের চেয়েও বহুগুণ বেশি চোখ ঝলসানো। এমন টপিক নিয়ে তাঁদের লেখার কথা বুঝলেন, আমি এ বাবদ নেহাত অজ্ঞ বললেও কম বলা হয়। এই সেদিন কোন এক শাড়ির পরিচয় দিতে গিয়ে ভ্যাবলার মত বলে ফেললুম ‘রেশম সিল্ক’। যাঁকে বলছিলুম সেই দিদিটি এদ্দিনে আমার সুনির্মল চিত্তের বিলক্ষণ পরিচয় পেয়েছেন, দিলেন এক ‘মনে হাসি গলায় রাগ’ মার্কা ধমক, “রেশম আবার সিল্ক কি রে হতচ্ছাড়ী, রেশমকেই সিল্ক বলে, আর সিল্ক মানেই রেশম। তোর মত জংলীকে বল্কল পরিয়ে ছেড়ে দিলেই ঠিক মানাত, ওই চান্দেরী সিল্কটা বরং আমায় পাঠিয়ে দিস।”

আমি রাগব কি, বুঝভুম্বুল হয়ে ভাবি, তাই তো! শাড়িটার তো এই নামটাই ছিল! নাঃ, এদের ক্ষমতা আছে মানতে হয়, শুদ্ধু ছবি দেখে শাড়ী চিনে ফেলে গা!

কিন্তু শাড়ি চিনি বা না চিনি, শাড়ির গল্প কি আর তা বলে হয় না আমার জীবনে! তবে এসব কিন্তু ঢের পুরোনো গল্প, যাকে বলে আমার “ছোটবেলার” কথা, এসব নিয়ে এখন প্যাঁক দিলে মোট্টে খেলবো না।

নিখুঁত পরিপাটি সেজে, মানে আইলাইনার না ধেবড়ে, চুল ডানদিকে উঁচু বাঁদিকে ল্যাপ্টানো না করে,  এমনকী লিপস্টিক লাগিয়ে সেটা চেটে না খেয়ে ফেলে, বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি হয়তো – মাতৃদেবী বলে বসেন “দেড় ফুট উঁচু করেই যদি পরবি তো এত শাড়ি সায়া ব্লাউজ না কিনে স্কার্ট পরলেই পারতিস!”

তাকিয়ে দেখি আমার দুই ঘন বাদামী গোড়ালি দিব্যি ড্যাব ড্যাব করে পরিদৃশ্যমান। তখন আর খুলে নতুন করে পরার সময় নেই, নিজে এবং মাতাঠাকুরানীর সহায়তায় শাড়ি কিঞ্চিৎ অধোগামী হলেন। খুব ইউনিফর্ম হল না ব্যাপারটা দুজনের দুরকম ফোর্সে ও অ্যাঙ্গেলে টানাটানির ফলে, কিন্তু কাজ চলে গেল। খালি এই ধস্তাধস্তিতে আঁচলটাও সম্পূর্ণ অকারণে ট্যারাব্যাঁকা হয়ে গেল, চুলের চারগোছা কানের পাশ দিয়ে কাঁধে ঝুলে পড়ল, আর বিয়েবাড়ি যাবারও কত পর খেয়াল হল বাহারী ম্যাচিং ব্যাগটা সোফায় ফেলে অফিসের হুমদো ব্যাগ কাঁধে নিয়ে চলে এসেছি।

কিংবা মাঞ্জা মেরে যাচ্ছি ঘুরতে, সর্বকর্মসহায়িকা এত্ত বড় হাঁ করে দেখল, তারপর হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসে প্রস্থানোদ্যত আমায় দরজা থেকে টানতে টানতে ঘরের মধ্যিখানে নিয়ে এল, তারপর হাটে হাঁড়ি ভাঙার মত সারা পাড়া জানিয়ে চিল্লে চিল্লে জানতে চাইল, আঁচলে ঝুলন্ত ব্লাউজপীস নিয়ে আমি ঠিক কোন ফ্যাশন শো-টা করতে যাচ্ছি।

আরে বাপু, আঁচলে ব্লাউজপীস জোড়া আমি কোত্থেকে জানব! পুরোটাই তো ঝিকিমিকি ডিজাইন, তার মধ্যে কোনটা হরাইজন্টাল কোনটা ভার্টিকাল অত কে দেখতে গেছে বলুন দিকি! এইজন্য আজ কুঁচি করতে গিয়ে ভুঁড়িতে শাড়ি কম পড়ল না। তা খারাপটাই বা কী দেখাচ্ছে এমন!

লোকজনের যদি কোন রসবোধ থাকে মশাই! সেই পালটিয়ে ছাড়াল। আমি গিয়ে দেখি জন্মদিনের কেক কাটা শেষ, গান গাওয়া শেষ, কেক মাখানো শেষ মায় বাড্ডে বাম্প অবধি ফিনিশ! ব্যাটারা কিছুমাত্র খাবার দাবার যে বাঁচয়ে রেখেছিল আমার জন্য সেই ঢের।

আচ্ছা আমার নিজের গল্প বলতে বসলেই আপনারা অমন আপিশ-আপিশ করে জিভের জল টানেন কেন বলুন দিকি! সবেতেই আপিশের গল্প গজায় নাকি!

অবশ্য, একেবারে যে নেই তাও বলছি না। একবার এক কচি ফ্রেশারকন্যা, আমার কাছে কাজ করে, ভারি ন্যাওটা হয়ে গেছে অল্প সময়েই, শাড়ি পরে এসেছে অফিস। মানে, ওই নভরাত্রি দিওয়ালির সময়ে প্রতিবার হুজুগ হয় সবাই শাড়ি পরে আসা হবে (উফ্, শুধু মহিলারা রে বাবা। ছেলেগুলো তো যেমন বেরসিক তেমনি বোরিং হয়।)। তা সে প্রথম অফিসিয়াল হুজুগে মত্ত হয়ে মায়াবী গোলাপী নেটের চুমকিচর্চিত শাড়ি পরে, মডেল-মডেল পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে আশেপাশে, আড়চোখে দেখে বেশ মজা লাগল।

খানিক পর ঘোর সন্দেহ হল। সে আমার চারদিকে চক্কর কাটছে তো কাটছেই! শেষে আর থাকতে না পেরে ঘুরে বসে মিষ্টি করে বললুম, “আমায় প্রদক্ষিণ করে তোমার কলাবৌ জুটবে না বাছা, কি মতলব খোলসা করে বলে ফেলো দিকি!”

তখন বেচারী বহুবার থেমে, বহুবার গলা খাঁকরে, ঘাম মুছে, নখ খেয়ে টেয়ে যা বলল তাতে আমি রীতিমত ভেবলে গেছিলুম।

তার বক্তব্য, টয়লেট পেয়েছে, কিন্তু যাবে কি?

মানে, মাইরি বলছি। কাজের ব্যাপারে ডিমান্ডিং বলে আপিশে একটু বদনাম আছে আমার সে সত্যি, কিন্তু আজ অবধি কারো টয়লেট যাওয়ায় বাগড়া দিয়েছি এমন অপবাদ হয়নি! আমার ব্যাদিত বদন দেখে সে আরো জানতে চায় আমি কি তার সঙ্গে যাব?

এসব কী বিটকেল বায়না বলুন তো! তোর টয়লেট পেলে আমারও পেতে হবে? না এটা ‘টয়লেট এক এক্সাম হল’ পেয়েছিস, আমি গিয়ে পাহারা দেব ফ্লাশ করলি কিনা! নাকি আমি গিয়ে শু…শু… করে শিস দেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? অ্যাঁ? বলি কাজ শেখাই বলে এসবও করতে বলবি?

কেমন দেখাচ্ছিল কে জানে আমার মুখ, মেয়ে হড়বড় করে ব্যাখ্যার ট্রেন ছোটায়। সে আগে শাড়ি পরেছে কিন্তু অনেকক্ষণ পরে থাকেনি, তাই শাড়ি পরিহিত দশায় টয়লেট যায়নি কখনো, তাই, আমি যদি যাই, মানে….

“আমি একা একা শাড়ি পরতে পারব না যে!”

শেষে মরীয়া আর্তনাদ।

এইবার ব্যাপারটা খোলসা হয়। হা হতোস্মি! ওরে আমার শৌখিন শাড়িবিহারিনী! তুই যে আমারও এক কাঠি ওপরে! তুই কি ভেবেছিস টয়লেট করতে হলে শাড়ি খুলে নিতে হয় আগে?

শুধু থ না, ত থ দ ধ ন হয়ে গেল পুরো। হয় না?

গম্ভীরস্য গম্ভীর গলায় ( উপায় কী! পেটে হাসির বোম ফাটছে যে!) বলি, লং স্কার্ট পরলে কী করিস, ছেমড়ি?

পাক্কা তেইশ সেকেণ্ড পরে বুঝল। একগাল হেসে পোঁ করে পালানোর পর আমাকেও সেই টয়লেটেই দৌড়তে হল, হাসি সামলাতে।

না, টয়লেট দিয়ে গল্প শেষ করতে নেই। তাই আরো একটা কচি ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’। এও আমার আপিশেই বটেক।

সে-ও এমন কোন শাড়ি ডে। ‘অ’ ঘন নীল সম্বলপুরীর আঁচল উড়িয়ে এসেছে, ব্যাগ রেখেছে, বসে ইমেইল চেক করেছে, তারপর চেয়ারের চাকায় একটুও শাড়ি আটকে না ফেলে কফি বানিয়ে এনে আয়েস করে চুমুক দিচ্ছে। এমন মনোরম সময়ে,

পটাং!

এবং ‘অ’ অনুভব করল আয়েসের হদ্দমুদ্দ হচ্ছে, সারা শরীর আরামে শিথিল হয়ে আসছে যেন। তারপর নড়েচড়ে বসতে গিয়ে হৃদয়ঙ্গম করল, শিথিলতা বড় ভাল জিনিস নয়। তার চেয়েও খারাপ ব্যাপার হল মাধ্যাকর্ষণ।

অতএব বকের মত মুণ্ড তুলে দেখল সামনের বে তে ‘আ’-ও শাড়ি পরে এসেছে।

অতঃপর একটা ছোট্ট কিন্তু তীব্র কথোপকথন। আপিশের মেসেঞ্জার চ্যাটে।

অ : সেফটিপিন আছে?
আ : দাঁড়াও দেখছি।
(একটু পরে)
আ : পেয়েছি একটা, বড় সাইজের। চলবে?
অ : দাও দাও শিগগির দাও।
আ : এই তো, এসে নিয়ে নাও।
অ : পারব না।
আ : কেন?
অ : কারণ, অঙ্গবস্ত্রের অন্তর্নিহিত অধোবাসের স্থাননির্ধারণকারী সূত্র আত্মহত্যা করিয়াছেন, এতদ্দশায় দণ্ডায়মান হইলে ওয়ার্ড্রোব ম্যালফাংশন অবশ্যম্ভাবী।
আ : মানে!!! ( এটা চ্যাটে না। সশব্দে।)
অ : এই চুপ চুপ চিল্লায় না!
আ : সরি সরি, আরে কন্ট্রোল করতে পারিনি আসলে। মানে জীবনে কখনো কারো বসে বসে সায়ার দড়ি ছিঁড়ে যেতে শুনিনি তো…
অ : ভাই, শুনে বা ভেবে থাকলে আমি কি আগে থেকেই সেফটিপিন লাগিয়ে আসতুম না রে! এবার এসে আমায় উদ্ধার কর। আর হ্যাঁ, অমন কান-এঁটো করা হাসি যদি বন্ধ না করিস তো পরের মড্যুলের ডিজাইনে মোক্ষম বাঁশ দেব বলে রাখলুম।

আ দৌড়ে এসে তারপর অ-য়ের মধ্যপ্রদেশে বার চারেক খোঁচা মারার পর সেফটিপিনকে সঠিক জায়গায় গেঁথে দিল, অ-ও উঠে দাঁড়িয়ে বাঁচল।

না, এদের কাউকে যদি আপনি চিনতে পেরেছেন বলে দাবি করেন, তো আমি সবেগে সজোরে অস্বীকার করে গেলুম।

 

Anustup Sett

Anustup Sett

অনুষ্টুপ শেঠ কলকাতার মেয়ে, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে স্ট্যাটিস্টিকসে মাস্টার্স করার পর থেকে প্রবাসী বাঙালী। অধুনা বোম্বের বাসিন্দা, একটি বহুজাতিক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কে কর্মরতা। আরো বড় পরিচয় হল একটি ছয় বছরের বকবকমবাজ কন্যার মা। অনুষ্টুপের ব্লগ, "সাপ্তাহিকী, তিতিরপাখি' বই আকারে প্রকাশিত। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই "ভুতোর বই" ছোটদের জন্য ছড়া-ছবির সংগ্রহ। আপিশ, বাড়ি, মেয়েকে মনোযোগ দেওয়া এবং নিজের শখের লেখা, বই পড়া ও বেড়ানো সমানতালে চালিয়া যাওয়ার চেষ্টা তাঁর নিত্যকর্মের অঙ্গ।

More Posts

Related posts

Leave a Comment