সমস্ত কোর্ট চত্বর লোকে লোকারণ্য ।আজ যে কেসের রায় ঘোষণা হবে, তেমন কেস আগে বোধহয় কখনও আসেনি বর্ধমানের মত কোর্টে ।চামেলি – প্রস্টিটিউট ;খুন করেছে নিজের ১৭ বছরের ছেলেকে ।এ এক অদ্ভুত কেস।অথচ সে নিজেই এসে আত্মসমর্পণ করে পুলিশের কাছে ।আজ অবধি কোনো উকিল নিয়োগ করে নি নিজের জন্য, দেয় নি কোনো আত্মসমর্থনে যুক্তি ।সবাই বুঝছে, চামেলির ফাঁসির সাজা ঘোষণা হবে ;তবু কৌতূহল – কেন করল।হাজারো মানুষের হাজার মতামত ।যথা সময়ে শুরু হল কোর্টের কাজ ।আজও নীরব চামেলি ।ভিড়ের মধ্যে থেকে ছিটকে আসে এক মহিলা -গালাগালের ফোয়ারা ছুটিয়ে। -“হারামজাদী, বারোভাতারি বেশ্যা মাগী, খেয়ে ফেললি ছেলেটাকে?! নিজেরটা তো গেছে ই, তোরটাকে দিয়ে কোল ভরাতাম – সহ্য হল না তোর? দিয়ে দিলি না কেন আমায় ।পাষাণী, রাক্ষসী, খেয়ে নিলি ছেলেটাকে!! ” পুলিশ এসে জোর করে সরিয়ে নিয়ে যায় তাকে ।সে ও নিষিদ্ধপল্লীর একজনই – পারুল।তার কথা শুনে সবাই ভাবছে – না জানি চামেলি কত বড় পিশাচ ।পারুল পরের ছেলের জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছে, আর সে নিজের ছেলেকে খুন করে দিল।
জজ সাহেব চামেলির ফাঁসির আদেশ দিয়ে উঠে যেতে যাচ্ছেন এমন সময় চামেলি বলে উঠলো – হুজুর, আমি আজ কিছু বলতে চাই ।যদিও রায় ঘোষণার পর আসামীর কোন বক্তব্য শোনা হয় না ।কিন্তু এ এক অদ্ভুত কেস ।বিচারক অনুমতি দিলেন ।
চামেলি বলতে শুরু করল.. . “আমার বাড়ি ছিল আড়া গ্রামে।মা মারা যায় অনেক ছোটোতে।সৎ মা – এর অত্যাচার আর অবহেলায় বড় হয়ে উঠি।১৯ বছর বয়সে একজনের সাথে প্রেম হয়।সে আমায় ঠকায় নি।বাড়ির অমতেও বিয়ে করেছিল আমায়।কিন্তু সুখ আমার কপালে সইল না ।সে এক আদর্শবাদী গৃহ শিক্ষক ছিল।সেবার ভোটের দিন গুণ্ডাদের হাতে মারা গেল সে।আমার ছেলে তখন আমার পেটে ।শাশুড়ি কোনোদিন পছন্দ করেন নি আমায়।ছেলে মারা যাওয়ার পর তাড়িয়ে দিলেন আমায়।সৎ মা – এর কাছেও জায়গা জুটল না আমার ।সেই থেকে হাজার হাত ঘুরে সমাজের হাজার নোংরা অলিগলি ঘুরে আমার এই ঠিকানা, এই পরিচয় ।ছেলেটাকে একটু বড় হতেই হস্টেলে দিয়ে দি-নোংরা পরিবেশে মানুষ হবে না বলে । আচ্ছা পারুলদি, গত বছর তোমার মেয়েটাকে কারা যেন মেরে ফেলে গেছিল, তাই না? পুলিশ জানিয়েও কেউ ধরা পড়েনি ।ফুটফুটে ১২ বছরের ফুলের মত মেয়েটাকে ভোগ করে মেরে ফেলেছিল ।১২ বছরের মেয়ের নগ্ন ধর্ষিত হওয়া লাশ আঁকড়ে পাগলের মত কেঁদেছিলে।আর তারপর থেকেই আমার ছেলে তোমার কাছে চোখের মনি হয়ে ওঠে । বিশ্বাস করো, আমার তাতে গর্ব হত।কিন্তু এবার ও হস্টেল থেকে ফিরে এসে পরের দিন সকালে যখন চাকরির পরীক্ষা দিতে গেল, সেদিন ওর বাক্সটা তালা দিতে ভুলে গেছিল।আমারও হাতে সেদিন কাজ ছিল না ।ভাবলাম, বাক্সটা গুছিয়ে রাখি। কী পেলাম জানো বাক্সে?? তোমার মেয়ের মারা যাওয়ার দিন পরা চিকনের কাজ করা সাদা ফ্রকটা – রক্তে ভেজা ।আর পেলাম শুকনো রক্ত মাখা ছোড়া ।বাড়ি ফেরার পর জেরা করতে ধীরে ধীরে সব স্বীকার করল । মাথার ঠিক রাখতে পারি নি ।যার শরীরে একজন আদর্শবাদী বাবার রক্ত বইছে, যাকে মানুষ করার জন্য আমি পাঁকে থেকে ওকে দূরে রেখেছি – সেই ছেলে এত নীঁচ ?!!! সেদিন রাতে ওকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলাম ভাতের সাথে ।তারপর ঘুমন্ত অবস্থায় সেই ছোড়া দিয়ে শেষ করে দিলাম পশুটাকে। আমার কোনো আফসোস নেই ।পুলিশকে জানালে হয়ত ধরা পড়ত – কিন্তু সঠিক শাস্তি হত না নাবালক বলে ।আমি পারতাম না, একটা পশুর মা হয়ে বাঁচতে ।”
মাটিতে লুটিয়ে পড়ল চামেলি ।জ্ঞান হারিয়েছে ।পুলিশ সুপার হাসপাতালে
নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন, জানা নেই চামেলির জ্ঞান আর ফিরবে কি না ।
কোর্ট চত্বর জুড়ে এখনও লোকারণ্য – গুনগুন, ফিসফাস ।
তারই ভিড়ে নীরবে কাঁদে বিচারের বাণী ।