বদুরডি থেকে ভোর বেলা উঠেই স্ক্যুটি নিয়ে দৌড় শুরু। রঘুনাথপুর হয়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে প্রায় ৫০ কিমি ঝকঝকে রাস্তা পার করতে লাগলো দেড় ঘন্টা। পুরুলিয়ার মতো ঘিঞ্জি শহর পেরিয়ে রাঁচি রোড ধরলাম। এই রাস্তাটার পাশ দিয়ে ট্রেন লাইনে একটা ট্রেনও আমার সঙ্গে কিছুটা ছুটলো । ট্রেনের সঙ্গে রেস করে যে আমিই জিতব এটা বলাই বাহুল্য। আমার কাছে কলা ছিল , এবং চায়ের দোকানের ডিম্ সিদ্ধ দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে চললাম বাদামকোদরের দিকে। ঠিক করেছি বেগুনকোদর হয়ে চাসামবাড়ি যাবো সেখান থেকে মুরুগুমা । এই পথ দিয়ে সাধারণত ট্যুরিস্টরা জান না। মুরুগুমা নামটা শুনলে বা ভাবলে বুকের ভেতর ধড়াস্ ধড়াস্ করে। মনে হয় কোনো আদিম অরণ্যে ঘেরা একটা লুকোনো পাহাড় , যেখানে পিগমিদের মতো আদিম উপজাতির মানুষখেকোরা বর্শার মাথায় মুন্ডু গেঁথে আগুনের পাশে গোল হয়ে হুম হাম আওয়াজ করে নারকেল পাতার জাঙ্গিয়া পরে নাচছে। কল্পনার সাইড এফেক্ট হচ্ছে রাস্তা ভুল করা। একটু ভুল শুধরে বেগুনকোদরে ঝকঝকে রাস্তা ছেড়ে সরু পিচরাস্তা ধরে পৌঁছলাম চাসামবাড়ি। এই ছোট গ্রামটা থেকে আরো একটা সরু মোরামের রাস্তা বেগুনকোদর হাইস্কুলের সামনে দিয়ে চলে গেছে মুরগুমার দিকে।একটু চলার পর বৃষ্টি শুরু , জুতো ভিজলে বড়ো বিরক্তি লাগে , তাই জুতো দুটো , সেলফোন আর মানিব্যাগ স্ক্যুটির সিটের তলায় চালান করে খালি পায়ে স্ক্যুটি চালানোই ঠিক হবে বলে মনে করলাম। রাস্তা ক্রমশই খারাপ হচ্ছে , আর প্রকৃতি ততই সুন্দর হয়ে উঠছে। সবুজ ধানক্ষেতের গায়ের কাছে এ পাহাড়টা বেশ বড়োসড়ো দেখতে লাগছে। কখনো অজানা ছোট নদী পার হচ্ছি। আরো কিছুটা এগিয়ে রাস্তা এতটাই খারাপ যে কাদা মাটিতে স্ক্যুটির চাকা হড়কাতে হড়কাতে ঢুকে গেলো। মনে মনে বললাম বেশ বাজে রাস্তাই বেছে বার করেছি, স্থানীয় মানুষরা চাষাবাদ করার কারণে এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাতায়াত করেন , আর আমি স্ক্যুটিতে। অযোধ্যা পাহাড় দিয়ে গেলে ২০ কিমি রাস্তা বেশি হলেও রাস্তাটা সুন্দর হতো। কিছুক্ষনের মধ্যেই দুটি স্থানীয় মানুষের সাহায্য নিয়ে স্ক্যুটি উদ্ধার করে পৌঁছলাম মুরুগুমা গ্রামে।
মুরুগুমা গ্রামে হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ি , বেশিরভাগ মাটির। গ্রামটার শেষে মুরুগুমা ড্যাম।এই গ্রামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো , “ডামান দত্ত ” । ওনার বাড়িতে একটি অ্যাটাচ বাথ ওয়ালা ঘর আছে (প্রথমে টাকা পয়সা নিতে না চাইলেও পরে ৫০০ টাকাতে রাজি হলেন )। নাম ও পদবীর প্রথম অক্ষর জুড়লে হয় D.D , এটা ভেবেই আমি খুশি হয়েগেলাম যে , চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়। মাটির দেওয়াল দেওয়া রান্না ঘর পেরিয়ে পেছনে সিমেন্টের দোতলা বাড়ির ওপরের ঘরটি আমার থাকার জন্য। কোনো বিছানা নেই , মেঝেতে একটা লেপ পাতা হয়েছে। একটা বসার প্লাস্টিকের চেয়ার যার একটা পায়া কাঠ দিয়ে সারানো হয়েছে। বাথরুমে জল আসছে না কারণ ওনাদের কুয়োতে লাগানো মেশিন খারাপ হয়েছে। এক বৃদ্ধা নাকি বালতি করে জল তুলে দেবেন , এ আবার হয় নাকি !! বললাম “মাসিমা চলুন আমি জল আনবো “, অনেক বোঝানোর পর উনি আমাকে বালতি বয়ে আনতে দিলেন। ঘরটায় একটা ব্যাপার ভালো লাগলো , দুটো জানলা দিয়েই সবুজ দেখা যায়। দুপুরে খাওয়ার পর বেশ বৃষ্টি শুরু হলো , জানালা দিয়ে সবুজ গাছগুলোর স্নান করা দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম কচুপাতার ওপর রুপোর মতো চকচকে জল জমেছে ।
বৃষ্টি থামতেই ছুটে চললাম ড্যামের দিকে , বেশ রোদ্দুর উঠলো। ড্যামের বাঁধের ওপর উঠে আমি বাকরুদ্ধ হলাম। উত্তরবঙ্গ বা অন্য বেশ কিছু পাহাড়ি জায়গা দেখেছি , কিন্তু নিজের বাড়ি থেকে ৩০০ কিমি দূরে , কেনিয়া বা তানজানিয়ার মতো একটা রহস্যময় নিস্তব্ধ জায়গা থাকতে পারে, এটা ধারণা ছিল না। চারদিকে গম্ভীর পাহাড় দিয়ে ঘেরা একটা জলাশয়। কোনো পাহাড় একটু ঝাপসা , কোনটা আবার বেশ কাছে। জায়গাটা ভালো করে যাতে সেলফোনে আঁটতে পারি তাই অযোধ্যা পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে কিছুটা ওপর থেকে ছবি বা ভিডিও তোলার চেষ্টা করতে করতে দেখলাম , মেঘ আবার কালো হচ্ছে ,সঙ্গে টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি । এই মেঘ রোদ্দুর আর বৃষ্টির খেলাটা দেখতে হয়। ছাতা নিয়ে গাছতলায় বসে গেলাম। মজাটা শুরু হলো রোদ্দুর আর মেঘের ঝগড়াটা নিয়ে , কখনো এদিক বা ওদিক দিয়ে উঁকি মারার চেষ্টা , যার ফলে ড্যামের জলে অদ্ভুত আলো ছায়া। ড্যামের পাশের লাল মাটির রাস্তার ধারে পাথরের উল্টানো বাটির মত বেশ বড়োসড়ো একটা পাহাড় আছে , । মনে মনে ঠিক করেই ফেললাম ওটার মাথায় চড়তে হবে। ……….
মুরুগুমা ড্যামের লাল মাটির রাস্তার ধারে একটা পাহাড়ের মাথায় এই নির্বান্ধব নিস্তব্ধ রহস্যময় এই মন্দির। মন্দিরের মধ্যে কোনো মূর্তি নেই। কয়েকটা ছোট পোড়া মাটির ঘোড়া রয়েছে। দু চার ফোঁটা বৃষ্টির জল গায়ে পড়তে ওপরে তাকিয়ে দেখি আকাশ কালো। পাহাড়ের মাথা থেকে চারি দিকে সেলফোনে দেখা অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশে পাহাড় ও জঙ্গল।
( ড্যামের ধারে একটা উল্টোনো পাথরের বাটির মতো পাহাড় আছে। এই মন্দিরটা ওই পাহাড়ের মাথায়। এই পাহাড়টায় ওঠার কোনো রাস্তা নেই , কোনোদিনই কোনো টুরিস্ট যায়না , তাই মন্দিরটা খুজেঁ পাওয়া বেশ মুশকিল এবং পাহাড়টায় ওঠার সেরকম কোনো রাস্তাও চোখে পড়েনি।)
