রবীন বাবু অল্প কিছুদিন হল চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন। চাকরী জীবনে অফিস আর ঘর, এ ছাড়া কিছুই জানতেন না। আজকাল দৌড় নিয়ে যে এত চিন্তা ভাবনা চলছে তা এতদিন বুঝতেই পারেন নি। মাঝেমধ্যে অবশ্য অফিস যাওয়ার পথে রোড ম্যারাথনের সন্মুখীন তাকে হতে হয়েছে। অবসরের পর কিছুদিন থেকেই ভাবছিলেন, দেহের মধ্যপ্রদেশটা যে ভাবে বেড়ে চলেছে তাতে কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু কিছুই করা হচ্ছিল না, শুধু মাত্র চিন্তা-ভাবনা ছাড়া। পঞ্চবার্ষিকি পরিকল্পনা আর কি। কিন্তু হঠাৎ কোমরে, হাঁটুতে যন্ত্রণা শুরু হওয়াতে আর কোন উপায় না দেখে তাকে ডাক্তারের শরণাপণ্ণ হতেই হল। ডাক্তার সোজা জানিয়ে দিলেন রোজ নিয়মিত দৌড়াতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। অগত্যা শুরু হল দৌড়।প্রথম দিন মাঠে দৌড়তে গিয়ে নজরে এল এক অপূর্ব দৃশ্য। অবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাই দৌড়াচ্ছে। এতো রীতিমত মেলা লেগে গেছে। তাঁর চেয়েও বৃহৎ বৃহৎ বপু দেখতে পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। নিজের দল ভারী দেখে মনে মনে খুশীই হলেন। কারো ভুড়ি লাউয়ের মত, কারো বা কুমড়ো আকৃতির। দেখলেন, কেউ কেউ কুকুর নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। আবার কারো কারো হাতে রুলার বা ছোট ছোট লাঠি। এই রুলার বা লাঠির ব্যাপারটা তার ঠিক মাথায় ঢুকছিল না। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল পাড়ার রসিকলাল বাবুর সাথে। রসিকলালের সাথে দেখা হতেই রসিকলাল বাবু এক গাল হেসে স্বাগত জানালেন। বললেন – “শেষ পর্যন্ত আপনি আমাদের দলে যোগ দিলেন। ভালই হল। দৌড়াতে দৌড়াতে সাহিত্য আলোচনা করা যাবে”। রবীন বাবু ভাবলেন, এখানেও সাহিত্য আলোচনা। জীবনে সাহিত্য আলোচনার বিভিন্ন আসরের কথা শুনেছেন কিন্তু দৌড়াতে দৌড়াতে সাহিত্য আলোচনা এই প্রথম শুনলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে সাহিত্য আলোচনা বেশ নতুনত্ত্ব লাগল। রসিকলাল বাবুর দৌলতে তাদের আলোচনা দৌড় বেশ ভালই জমে উঠেছিল। রসিকলাল বাবুর থেকেই জেনেছিলেন যে, কুকুর নিয়ে যারা দৌড়াতে আসেন, তারা আসেন কুকুরের প্রাতঃকর্মের তাগিদে এবং এই সুবাদে দৌড়ানও হয়ে যায়। অর্থাৎ রথ দেখা আর কলা বেচা আর কি। আর যারা হাতে রুল বা ছোট লাঠি নিয়ে দৌড়াচ্ছেন, তারা রুল বা লাঠি আনেন কুকুরের কামড় এবং বাঁদরগুলোর থেকে প্রাণ বাঁচাতে।
পরের দিন ভোরেও যথারীতি দৌড়াতে পৌঁছে গেলেন সেই পার্কে। এবার আরো অবাক হওয়ার পালা। দেখলেন এক টি.ভি. চ্যানেলের লোকেরা গাড়ী নিয়ে এসে পার্কের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। লোকেরা চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে তাঁদের। ভীড় ঠেলে ভেতরে পৌঁছেই দেখলেন, সেখানেও তাঁর পরমবন্ধু রসিকলাল বাবু টি.ভি.-র লোকেদের দৌড় সম্পর্কে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। দৌড়ের যে এত মহিমা তা আগে রবীনবাবু-র জানা ছিল না। তাই ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছিলেন। টি.ভি.র ইন্টারভিউ মোটামুটি এই প্রকার ছিল –
সাংবাদিক – (রসিকলাল বাবু-কে উদ্দেশ্য করে) আচ্ছা, আপনি তো রোজ দৌড়াতে আসেন, দৌড়ানো সম্পর্কে কিছু বলুন।
রবীনবাবু ভাবলেন এখানেই হয়তো ইন্টারভিউ-র পরিসমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু না, রসিকলাল বাবু বীরদর্পে বলে চললেন –
“দৌড় নানা প্রকার হয়। যেমন – ডায়াবেটিস দৌড়, হুজুগে দৌড়, গণ দৌড়, রোমান্টিক দৌড়, ইত্যাদি ইত্যাদি”।
সাংবাদিক – যদি একটু বুঝিয়ে বলেন তাহলে আমাদের দর্শকদের জন্য ভাল হয়।
রসিক লাল বাবু- ডায়াবেটিস দৌড় – খুব ভোরে কিংবা বিকেল বেলায় পার্ক অথবা ফাঁকা রাস্তায় গেলেই আপনি এই দৌড়ের দেখা পেয়ে যাবেন। দেখবেন, ডায়াবেটিসের হাত থেকে বাঁচার জন্য এখানে ভুঁড়ি দুলিয়ে দুলিয়ে হালকা তালে অসংখ্য বুড়োবুড়ি কেমন অবিরাম দৌড়াচ্ছেন। বুড়োবুড়িদের এইরকম হাল্কা তালের ডায়াবেটিস কন্ট্রোল দৌড়কেই বলা হয় ডায়াবেটিস দৌড়।
হুজুগে দৌড় – কোথাও কোন একটা বাজী বা রিকশার টায়ার ফেটেছে। ব্যাস্, শুরু হয়ে গেল দৌড়। শব্দটা শুনেই এর আশে পাশে যে দু’-চারজন ছিল তারাও সঙ্গে সঙ্গে জোড়ে দৌড় লাগায়। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় যারা দৌড়াচ্ছে স্রেফ তাদের দেখাদেখি প্রায় পুরো এলাকার লোকজন যে যেদিকে পারছে সবাই রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। অন্যের দেখাদেখি এই ধরণের দৌড়কেই বলা হয় হুজুগে দৌড়।
গণ দৌড় – চোরটি যখন তার নিজের কাজে ব্যাস্ত, হঠাৎ তখন যদি কেউ তাকে দেখে ফেলে দৃশ্যটা এবং চিৎকার করে ওঠে। তখন দেহের সবটুকু শক্তি এক করে দৌড় লাগায় চোর। পেছনে শত শত মানুষ মিলিত ভাবে তাড়া করে। চোর……চোর…… ধর …… ধর …… আওয়াজ তোলে ও প্রবল উৎসাহে সবাই চোরের পেছনে পেছনে দৌড়ায়। অসংখ্য মানুষের এরূপ মিলিত দৌড়কেই বলা হয় গণদৌড়।
সাংবাদিক – রোমান্টিক দৌড় তাহলে কাকে বলে?
রোমান্টিক দৌড় – পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে প্রেমিকার বাড়ীর অনেকটা কাছাকাছি চলে আসে প্রেমিক। বুকে এক সমুদ্র ভালবাসা এবং হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। হঠাৎ যদি তাকে দেখে ফেলে প্রেমিকার মাস্তান ভাইটি। বেচারা প্রেমিক ততক্ষণে ভালবাসা ভুলে ইজ্জত বাঁচাতে চিতার গতিতে দৌড় লাগায়। প্রেমিকার মাস্তান ভাইদের তাড়া খেয়ে প্রেমিকদের এরকম ম্যারাথন দৌড়কেই বলা হয় রোমান্টিক দৌড়।
সাংবাদিক – আচ্ছা, দৌড় সম্পর্কে আপনি আমাদের দর্শকদের কি পরামর্শ দিতে চান?
রসিকলাল বাবু – নিয়মিত দৌড়ের প্রাকটিসটা রাখা ভাল। যারা ছাত্র-ছাত্রী, তাদের জন্যও দৌড়ানো খুব জরুরী, কারণ আজকাল আন্দোলন, ধর্মঘট, গোলাগুলি, মারামারি, পুলিশের লাঠি ইত্যাদির সন্মুখীন তাদের হতেই হয়। তাই দৌড়ানো ছাড়লে চলবে না।
রাস্তায় গণ্ডগোল হলে বা পাওনাদাদের থেকে বাঁচতেও এর প্রয়োজন হতে পারে। তাই তখন কিন্তু এটা খুব কাজে লাগবে। তাই বলতে পারি দৌড়ের কোন বিকল্প নেই।
সাংবাদিক – (জনতা কে লক্ষ্য করে) আপনাদের দৌড় সম্পর্কে কি মতামত?
জনৈক ডাক্তার – দৌড় হচ্ছে খুব ভালো ব্যায়াম। নিয়মিত দৌড়ালে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং শরীর সুস্থ থাকে।
কবি – দৌড় হচ্ছে মেঘবতী লাজুক কিশোরীর মলযুক্ত শুভ্র পদযুগলের খেয়ালী ছুটে চলা।
চিত্র পরিচালক – দৌড় হচ্ছে আমার পরবর্ত্তী ছবির নাম।
উকিল – দৌড় হচ্ছে এক প্রকার অপরাধ। বিশেষ করে কোনো কারণ ছাড়াই জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধের মধ্যেই পড়ে। আমাদের দেশে এই অপরাধের জন্য কয়েক বছর সশ্রম কারাদণ্ডের ব্যাবস্থা আছে। যে কেউ এই অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন।
জনৈক টাকার পাগল – দৌড় কী সেটা অবশ্যই বলব। তার আগে বলুল তো, টাকা-পয়সা কিছু পাওয়া যাবে কিনা।
জনৈক আঁতেল – দেখুন, দৌড় ব্যাপারটা ইনফ্যাক্ট আপেক্ষিক। জেনারেলি দৌড় বলতে সজোরে ঠ্যাং সঞ্চালনকে বোঝালেও আমাদের আর্থিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব এবং অর্থ অনেক ব্যাপক। এ ব্যাপারে এক দার্শনিক বলেছেন ……।।
রবীন বাবু দেখলেন ব্যাপারটা ক্রমশই গোলমেলে হয়ে উঠেছে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলেন স্ত্রী-র অফিস যাবার সময় হয়ে গেছে। দোকান বাজার করতে হবে। আজ আর দৌড়ানো যাবে না। অগত্যা বাড়ীর দিকেই দৌড় দিলেন, নয়তো রেসেসনের যুগে স্ত্রী-র চাকরীটাও থাকবে কিনা জানা নেই।