আজ কলেজে নবীন বরণ। চারিদিকে সাজো সাজো রব। শেষ বারের মত ঝালিয়ে নিচ্ছে নিজেদের ভুমিকা। সন্ধ্যে হলেই শুরু হবে অনুষ্ঠান। নতুনদের মধ্যেও অন্যরকম এক উন্মাদনা। এক ঝাঁক প্রজাপতির মত ঝলমলে সাজগোজে যেন চারদিক মাতিয়ে চলেছে সকলে। শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে। উদ্বোধনী সংগীতের পর হবে নাটক, দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশনায়।সামনের সারিতে বসে মন কাড়ে নাটকের এক বিশেষ চরিত্র, বিক্রম। অবাক নয়নে দেখে চলে অভিনয়ের খুঁটিনাটি। সমস্ত অভিব্যক্তির স্বাদ নিজের মধ্যে গ্রহণ করে চলেছে। মায়াবী আলোয় যেন অপরুপ। স্বপ্নমায়ায় জড়িয়ে গেছে মন। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠতে সম্বিত ফিরে পায়। অনুষ্ঠান শেষে খুঁজেই চলে তাকে। দেখা আর হল না।
বাড়ি ফিরে এসেও মনের মধ্যে সেই একই ছবি। চরিত্রটার সাথে মিশে গিয়ে যেন সত্যিই ও, ‘বিক্রম ‘ হয়ে গেল রোশনির কাছে।
পরের দিন কলেজে গিয়েও চোখ খুঁজে বেড়ায় তাকে। হঠাৎ করিডোরে দেখে বুকের মধ্যে অদ্ভুত উত্তেজনা। লাজুক রোশনি পারে না এগিয়ে যেতে, দুর থেকেই দৃষ্টিতে তাকে নিজের করে নেয়।
এরপর সময় কাটে, উদ্বেলিত মন যেন চোখে হারায়। বন্ধুদের মাঝখানে একদিন কথায় কথায় আলাপ। নাম জানা হল…. অর্পন। কথাবার্তার মাঝেই রোশনি হারিয়ে ফেলে নিজেকে। সমস্ত সত্ত্বায় জুড়ে গেল তার বিক্রম।
বন্ধুত্ব এগোয়, নিছক বন্ধুত্ব। বিক্রমের দৃষ্টিতে রোশনি খুঁজে ফেরে নিজেকে, পায়না কোথাও। একদিন বলেই ফেলে
অর্পণ একটা কথা বলব যদি কিছু মনে না করিস
হ্যাঁ বল না…. এত কুন্ঠা কেন
চুপ করে যায় রোশনি… না থাক… পরে কখনো..
অর্পনের জোড়াজূড়িতে শেষ অবধি বলেই ফেলে
হ্যাঁ রে কিছু ভেবেছিস
অবাক অর্পনের প্রশ্ন… কি বিষয়ে
আমাদের বন্ধুত্বের… বিশেষ বন্ধুত্বের
অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে অর্পণ রোশনির দিকে
শেষ কথাগুলোয় উদভ্রান্ত রোশনি। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে যাওয়া জলের ধারা কিছুতেই সামলাতে পারে না। অনেক বোঝায় অর্পণ… তার সঙ্গে পৃথার সম্পর্ক অনেক দিনের, আগামী পথ চলার স্বপ্ন দেখেছে দুজন।
অশান্ত মন, ঘুরেফিরে একই কথা ভেবে চলেছে। অনেক বুঝিয়েও নিজেকে বোঝানো গেল না। আর না পেরে মনে মনে শপথ নিল…. ভালবাসা থাক ভালবাসা হয়েই।
আজ বহুবছর কেটে গেছে। চার্টার্ড একাউন্টেসি পাশ করে হায়দ্রাবাদে কর্মরত রোশনি। মনের মাঝে ভালবাসাকে সঙ্গী করে একাই পথচলা। মন্দ লাগে না অবসরে নাড়াচাড়া করতে ভাবনাগুলোকে। অদ্ভুত এক তৃপ্তি, যেন অন্যকাউকে ভাগ দিতে হয়নি মনের এতটুকুও।
একবার কলেজের রি-ইউনিয়নে দেখা হয়ে যায় অর্পনের সাথে… রোশনির বিক্রম। কলকাতাতেই থাকে… পৃথাকে সঙ্গে নিয়ে মসৃণ পথচলা। ফোন নং বিনিময়। নিয়মিত কথাবার্তা না হলেও যোগাযোগ রয়ে যায়।
বেশ কিছুদিন হল মাথার যন্ত্রণাটা বড্ড ভোগাচ্ছে রোশনিকে। বহুকালের কষ্ট তবুও আজকাল কেমন যেন অসহ্য হয়ে উঠেছে। সারাদিন পর রোজ সন্ধ্যের দিকে শুরু হয়। চারিপাশ তখন অন্ধকার লাগে। আগে চিকিৎসা করেছিল, তেমন কোন অসুবিধের কারন জানা যায়নি। স্বপ্ন দেখতে দেখতে বোধহয় মাথার শিরাগুলো জমাট বেঁধে গেছে এমনটাই মনে হয় আজকাল। একদিন তো অফিসেই জ্ঞান হারিয়েছিল। অবশেষে সহকর্মীদের বকাবকিতে ডাক্তার দেখাতেই হয়। বিভিন্ন রকম পরীক্ষা,…. এবার জানা গেল সত্যিটা। আজ কেমন নিশ্চিন্ত লাগছে নিজেকে। মেজাজটাও ফুরফুরে হয়ে গেল। মনের মাঝে একটাই কথা ঘোরাফেরা করছে… এতদিনে তবে ছুটি মিলবে। আমার ভালবাসা আমারই থাকল…. কেউ ছুঁতে পারেনি তাকে… সমস্তটুকু দিয়ে নিজের কাছে আগলে রেখেছি এতবছর…. আমার সাথে আজ তা মুক্তি পাবে।
হঠাৎ মুঠোফোন বেজে ওঠে।
অর্পণ বলছি
হ্যাঁ বল কি খবর
আমি ভাল রে….. তুই
আমি খুব ভাল রে… প্রমোশন হয়েছে
অভিনন্দন
একটা কথা রাখবি অর্পণ
নিশ্চয় রাখব… বল
আমি কলকাতায় এসেছি… দেখা করবি একদিন… একটিবার তোকে দেখব
ঠিক আছে… কবে বল
কালই একবার আয় না…. রবীন্দ্রসদনে
আচ্ছা আসব, ঠিক বিকেল পাঁচটায়
দুজনেই পৌঁছে যায় ঠিক সময়ে, সাদা লালের ঢাকাই শাড়িতে সেজেছে রোশনি। অন্যরকম লাগছে তাকে। অনেক গল্প হল দুজনের। শেষ বেলায় হাত মিলিয়ে বলে গেল রোশনি…. আসি রে… আর বোধহয় দেখা হবে না কোনদিন। আমার সবটা জুড়ে শুধু তুইই.. ভালো থাকিস
অর্পণ দেখল রোশনির চলে যাওয়া… চিরদিনের মত..
চোখভরা জলে ঝাপসা চারপাশ…..
‘ভালবাসা থাকল ভালবাসা হয়ে’
মন ছুঁয়ে যায় যা, ঠিক সেই ভালোবাসার স্বর্ণকাঠির খোঁজ পেলাম।