ত্রিতাল – অথবাতিনতালকানারগল্প

।।১।।

এই যে এত বছর কর্পোরেট জগতে চরে খাচ্ছি, একটা জিনিস কিন্তু শুরু থেকেই দেখেছি। পুরুষ সহকর্মীরা মহিলাদের সাথে মেলামেশায় রীতিমত সতর্ক থাকেন। ব্যতিক্রম নেই বলছি না, কথাবার্তায় অতি ঘনিষ্ঠ ভাব দেখানো, ছুতোনাতায় গায়ে ছুঁয়ে যাওয়া, বাসে পাশে বসলে গোপালের প্রসাদ দেবার নামে বুকে কনুই ঠেকানো – এসব একদম যে হয়নি তা বলব না কিন্তু সেগুলো বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রমই, আমি একেবারে জুনিয়র থাকতে, এবং এইচ আর কে জানানোর পর এসব বদ লোক বেশিদিন কোম্পানিতে টেঁকেনি। একটু পোক্ত হবার পর, এসব নিয়ে আর একেবারেই মাথা ঘামাতে হয়নি।

হয়তো আমি যখন থেকে কাজ করতে শুরু করেছি মোটামুটি তখন থেকেই অ্যান্টি সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট রুলের সূত্রপাত বলে অন্য রকম কিছু দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি। বড় কোম্পানিগুলো এ বাবদ বেশ সতর্ক ও কঠোর।

খালি একবার, মাত্র একবার, এক অতি সিনিয়ার, অতি সুপুরুষ ও অতি স্বল্পভাষ  উপরওয়ালা আমায় আচমকা দুই হাতে কাঁধ খামচে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। ভদ্রলোকটিকে, মানে ভদ্রলোক বলেই তো জানতাম, আমি রীতিমত অ্যাডমায়ার করতুম আবার। স্মার্ট, ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা, নিজের কাজে ভয়ানক চৌখশ বলে নামযশ – অ্যাডমায়ার করব নাই বা কেন! কিন্তু, উফ্, সে যে কি ভয়ানক কান্ড! এখনো সে দিনের কথা মনে পড়লে কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়।

খুব পুরোনো কথাও নয়। আমার বেশ অনেক অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে তদ্দিনে। অ্যাপ্লিকেশনের নখরা, সফটওয়্যার এর কোডে বজ্জাত বাগ-এর লুকোচুরি, ইউজারদের বায়নাক্কা, বসের বেয়াক্কেলে প্রশ্ন, জুনিয়রদের আবদার, প্রোডাকশনের আগুন, দেড়দিবসব্যাপী নিদ্রাহীন রিলিজ – এসবই ‘চিত্ত ভাবনাহীন’ হয়ে সামলে নিতে পারি। এরকম এক নিদাঘদুপুরে, পূর্বোক্ত প্রোডাকশনের আগুনে বেগুনস্যাঁকা হচ্ছি। কেস কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত গড়বড়, মাথায় সাধারণত যেমন চটজলদি উপায় খেলে যায় তেমন কিছু লাগসই আজ পাচ্ছি না। এদিকে একটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমাধান খুঁজে না পেলে কিসব ক্যালকুলেশন মুখ থুবড়ে পড়বে, সেটা হলে কিসব রিপোর্টের ডেডলাইন উল্লঙ্ঘিত হবে, আর তা হলে তো, ওরে বাবা! সব বাঘা বাঘা লোকজন কুড়ুল করাত নিয়ে রে রে করে তেড়ে আসবে। ডমিনো এফেক্ট যাকে বলে!

কাজেই নিদারুণ চাপার্ত হয়ে, দুটো মনিটরের মধ্যে জাগলিং খেলতে খেলতে হঠাৎ টের পেলুম আরো চাপ!

মানে, ব্ল্যাডারে চাপ পড়িয়াছে। অনেকক্ষণ আগেই পড়েছে, কাজের ঝোঁকে চেপে বসেছিলুম, কিন্তু আর সম্ভবপর নয়।

উঠে রওনা দিয়েছি কি দিইনি, চড়াক করে বিদ্যুচ্চমকের মত মাথায় একটা আইডিয়া এল। সেটা হয়তো শ্যাম কূল বেন্দাবন সব রেখে সমস্যাটা আপাতত সামাল দিতে পারবে। যত ক্ষিপ্র পায়ে যাচ্ছি, ততোধিক ক্ষিপ্রতায় মাথায় মেপে নিচ্ছি আইডিয়াটার আগাপাশতলা, বুঝতেই পারছেন তখন আর আশপাশে কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে হুঁশ নেই। আর টয়লেট ব্যাপারটা তো এক সাইডে, একটু একটেরে, আড়াল আবডালেই হয়! টের পেলুম একেবারে যখন পিছন থেকে বলিষ্ঠ হাত দুটো এক হ্যাঁচকায় একদম কাছে টেনে নিয়েছে।

নাহ। এইচ আর কেন, কাউকেই বলিনি ঘটনাটা। লজ্জায়। তবে ভদ্রলোককে, ভদ্রলোক না তো কি বলি, অজস্র ধন্যবাদ জানিয়েছিলুম। উনি না থাকলে, আমি অমন ধূমকেতুর স্পীডে মেন’স টয়লেটে ঢুকে পড়তুম যে আরেকটু হলে!

।।২।।

ব্যাস! অমনি হেসে হাল্লাক হয়ে যেতে হোলো তো? তাহলে পরের গল্প টা পড়ে কি করবেন শুনি?

না মশাই, এটা আমার কীর্তি নয়। পৃথিবীর সব সুকীর্তি কি একা আমি করব নাকি! অন্যদেরও প্রতিভা দেখানোর কিছু সুযোগ দিতে হয় তো!

কবে, কোথায়, কে সেসব কিচ্ছুটি বলব না। অত জানা ভাল নয়! তবে এটুকু বলছি কোন এক… ইয়ে, কি বলা যায় বলুন দিকি…হয়েছে….জনবহুল তাঁবুশোভিত প্রাঙ্গনে।

আহারাদির পর হাত ধোওয়া দরকার, সাথে একটু হালকা হবারও। তাতে অসুবিধে কিছু নেই, সামনেই টয়লেট দৃশ্যমান। অসুবিধে হল আমার কাঁধে গায়গতরে ব্যাগ একখান, আর পুরুষ সঙ্গীটির হাতে দু না তিনখানা বইভর্তি ঝোলা। ঐ যাঃ, বলেই ফেললুম কোথায়! যাগগে, কথা হচ্ছে এত জিনিস নিয়ে যাব ক্যামনে! তাই বললুম, আমি এগুলো নিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুমি সেরে এসে ধরো তখন আমি যাব।

বলতে যা দেরি! খুব জোর পেয়েছিল বোধহয়,  তিনি দেড়মণী প্যাকেট আমায় ধরিয়ে দিয়ে ধাঁ করে সামনের লেডিজ টয়লেটে ঢুকে পড়লেন।
আমি হাঁ হাঁ করে ‘ওটা নয় ওটা নয় ওটায় না পাশেরটায় যাও’ বলতে বলতে দেখি ব্যাটাচ্ছেলে বেশ করে বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে ডাঁটের মাথায় সুর ভাঁজতে ভাঁজতে বেরিয়ে পাশের দরজা দিয়ে, যেটা কিনা আদত জেন্টস টা, ঢুকে গেল। আমার দিকে তাকাল তো না-ই, এমন কি আমার হাহাকারে কর্ণপাতও করল না।

আমি আর কি করি। প্রথমে বদন ব্যাদান করে দাঁড়িয়ে রইলুম। তারপর পেট থেকে ঠিক সেই সোডার মত ভসভসিয়ে হাসি উঠে এল। একা একা, ব্যাগ হাতে হো হো করে হাসতে হাসতে যখন চোখে জল এসে গেছে, তখন দেখি জেন্টস টয়লেট থেকে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে, কি মুখ মুছতে মুছতে, কি প্যান্টের চেন টানতে টানতে যে-ই বেরোচ্ছে সে-ই আমায় দেখে কেমন  ভড়কে গিয়ে অন্যদিকে পালাচ্ছে। তখন জোর করে হাসি থামিয়ে গম্ভীর মুখ করলুম। সময়মতো করেছিলুম, কারণ পরক্ষণেই বন্ধুবর বেরিয়ে এলেন।

বই, ব্যাগ সব তার হাতে চালান করে পা বাড়িয়েছি, পিছন থেকে মন্দ্রস্বরে সস্নেহ ডাক, ‘এই ওখানে না, তোমাদেরটা মনে হয় ঐ পাশে।’

মুখ খোলার আর সাহস পাইনে, আবার অমন হাসি পেয়ে গেলে! শুধু আঙুল দিয়ে ‘লেডিজ’ লেখাটা দেখিয়ে দিই।

একটুক্ষণ স্তব্ধতা।

তারপর “যাঃ!” বলে একটা আর্তনাদ।

তারো পর, “কি! আমি লেডিজ টয়লেটে হাত ধুয়ে এলুম! সত্যি? ধ্যাৎ! এ বাবা!” বলতে বলতে বীরপুরুষের সবেগে পলায়ন, আমার ব্যাগ হাতে  নিয়েই। মুখ দেখে মনে হল জীবনে আর কখনো টয়লেটে, অন্তত মেলার টয়লেটে যাবে কিনা সন্দেহ!

 

।।৩।।

আরো চাই?! আপনাদের চাহিদার সীমা পরিসীমা নেই সত্যি! এইটাই শেষ কিন্তু এখনকার মত।

এটা পুরোনো গপ্পো। সুখেষুবিগতস্পৃহ হওয়া আমি মোটে সাপোর্ট করি না, কিন্তু দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা হওয়া খুব ভাল ব্যাপার। তার চেয়েও ভাল ব্যাপার হল ছড়ানোর পর অবিচলিতহৃদয় থাকতে পারা। (এই জায়গাটা সংস্কৃতে অনুবাদ করে দিতে জ্ঞানীজনদের অনুরোধ করেছিলুম, মানে সংস্কৃতের যুগে লোকেরা ছড়াতো না এটা অবিশ্বাস্য, কাজেই তার কোনো জম্পেশ প্রতিশব্দ থাকবে না এটা মানা যায় না! তা কি আর বলব, বিশেষজ্ঞদের একজন সেটা শুনে আমায় হাতে পেলেই ডিকশনারি পেটাবেন বললেন, আরেকজন ছড়ানো শব্দটার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করে কান-টান লাল করে ছেড়ে দিল।)

তো, কোনো এক শহরে, কোনো এক বন্ধুদের মিলনোৎসব। এক নামীদামী কফিশপের খোলা চত্বরে সেই সংখ্যাগুরু ও স্বভাবলঘু তরুণতরুণীদের গ্রুপের হি হি হা হা চলছে, তাদের সামনে বাকি খরিদ্দাররা স্তম্ভিত সংকুচিত স্তিমিত। সেখানে এক সর্বজনপ্রিয় দিদি বাক্স ভরে দুর্দান্ত টেস্টি দানাদার এনেছে আবার সবার জন্য। সবাই খাচ্ছে, আমিই বা বাদ যাই কেন! তাকে একটু ফাঁকায় পেতেই লাফাতে লাফাতে গিয়ে হাজির হই, “আম্মো খাব!” বায়না সহ।

দিদি বাক্স বাড়িয়ে দেয়।
আহ্লাদী গলায় বলি, “হাত চটচটে হয়ে যাবে, তুমি খাইয়ে দাও!”
বলে তার সামনে হিপ্পোর মত বিশাল হাঁ করে দাঁড়াই।

অক্কা পেতুম আরেকটু হলে। বলামাত্র দিদি একদম আলজিভ টিপ করে এক পিস দানাদার ছুঁড়ে দিয়েছিল। কি ভাগ্যিস টিপ খারাপ!

পাশে দাঁড়ানো দাদাভাই তো তেড়ে ধমকাতে লেগে গেল দিদিকে, আক্কেল না আক্কেলদাঁত কিসের অভাব টভাব বলে, আমি তখনো কাশি সামলাচ্ছি।

দিদি অকুতোভয়। বলল, “আরে, আমি নিজে তো এভাবেই খাই!”
শুধু বলাই নয়, ডেমোও সঙ্গে সঙ্গে। উপর দিকে মুখ করে, হাঁ করে, দিল একটা মিষ্টি উপরে ছুঁড়ে।

আমি আর দাদাভাই হতভম্ব হয়ে দেখলুম, সেটি সোঁ করে উপরে উঠল, তারপর দিদির মাথা টপকে, পিছনের টেবিলে বসা দুই কলকূজনরত সেমি-দম্পতির পুং টির মাথায় টং করে ল্যান্ড করল।

আর দাঁড়ায়! দাদাভাই একদিকে দৌড়ে স্যাট করে আমাদের টেবিলে বসে পড়ে কার যেন কফি কেড়ে নিয়ে চুমুক দিতে লাগল। আর আমি অন্য দিকে দৌড়ে দুই বন্ধুর ঘনিষ্ঠ গলাজড়াজড়ির মধ্যে গুঁতিয়ে ঢুকে গেলুম। ঢোকা মাত্র চোখ ধাঁধানো ফ্ল্যাশ, সে বেচারারা এতক্ষণ বহু কসরৎ করে, আলো-অ্যাঙ্গল-ছুঁচোমুখ সব পছন্দমাফিক বানিয়ে, দ্বৈত সেল্ফি তুলতে যাচ্ছিল সবে – আমার বিহবল বদনচন্দ্রিমা তাদের দুজনের মধ্যে মূর্তিমান রসভঙ্গ হয়ে লেপটে গেল।

আর আমাদের অনন্য অসামান্য দিদি, সেই হতচকিত যুগলের দিকে বাক্সটি বাড়িয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, “ব্যাপক খেতে, খেয়ে দেখুন!”

নাহ,  তারা বেরসিক ছিল না। খেয়েছিল, মুচকি হাসি সহযোগে।

——

Anustup Sett

Anustup Sett

অনুষ্টুপ শেঠ কলকাতার মেয়ে, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে স্ট্যাটিস্টিকসে মাস্টার্স করার পর থেকে প্রবাসী বাঙালী। অধুনা বোম্বের বাসিন্দা, একটি বহুজাতিক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কে কর্মরতা। আরো বড় পরিচয় হল একটি ছয় বছরের বকবকমবাজ কন্যার মা। অনুষ্টুপের ব্লগ, "সাপ্তাহিকী, তিতিরপাখি' বই আকারে প্রকাশিত। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই "ভুতোর বই" ছোটদের জন্য ছড়া-ছবির সংগ্রহ। আপিশ, বাড়ি, মেয়েকে মনোযোগ দেওয়া এবং নিজের শখের লেখা, বই পড়া ও বেড়ানো সমানতালে চালিয়া যাওয়ার চেষ্টা তাঁর নিত্যকর্মের অঙ্গ।

More Posts

Related posts

Leave a Comment