জানা অজানার পথে – মেঘ আর কুয়াশার সাথে

13592696_215864802141919_4822098195110821951_n-1

আগের পর্বে জানা অজানার পথে / জোঁকের সাথে র পর লামেহেধুরা থেকে।……….

লামেধুরা থেকে ভ্যালি তে নামতে যাবো এমন সময় হটাৎ সেই মেমসাহেব এর সঙ্গে দেখা। চিত্রে তে উনি ও একই হোম স্টে তে ছিলেন এবং টুক টাক আলাপ ও হয়েছিল। দুজনেই ইংলিশে সুপ্রভাত বললাম , জানলাম উনি উপরে যাচ্ছেন, মানে এই সময় টুম্বলিং পর্যন্ত যাবার অনুমতি আছে। তাই উনি পিঠে ঝোলা নিয়ে হাঁটা লাগিয়েছেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করায় আমি আমার ভোর বেলা থেকে অভিজ্ঞতা ও জোঁকআতংক র কথা বললাম। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সেলফোনে কিছু ছবি ও দেখালাম । উনি ছবি দেখে উৎসাহী হয়ে পড়লেন এবং বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আমাকে গাইড ও সঙ্গী হতে বললেন। বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার ,সঙ্গী তাও আবার বিদেশিনী 🙂 , কিন্তু হায় রে কপাল আমি নিজেই রাস্তা চিনি না। সে যাই হোক বিদেশ থেকে আসা অতিথি বলে কথা, তাঁকে আমার দেশ টা দেখানো উচিত , কিন্তু ওই একনাগাড়ে সাদা চামড়া মানুষের ভাষায় কথা বলাটা খুব ই বিরক্তিকর আমার কাছে , তাই অনেক কষ্টে জোঁকের ভয় দেখিয়ে ওনাকে নিরস্ত করলাম। এদিকে আমার আবার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার জন্য মন মোচড় খাচ্ছে — আরে না না আপনারা যা ভাবছেন তা না — মানে প্রকৃতির আরো কাছে যাবার ইচ্ছা জাগছে।

13512141_215864832141916_8678472660031350817_n-1

ওনাকে বিদায় জানিয়ে রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়লাম ভ্যালির মধ্যে। এদিক টা জঙ্গল নেই , দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ভেজা ঘাস এর উঁচু নিচু ভ্যালি। আমার সঙ্গে চলেছে সালু – ও সালুর কথা বলা হয় নি , ভোর বেলা থেকে একটা রাস্তার কুকুর আমার সঙ্গী হয়েছে , ওর রং সাদা তার ওপর কালচে লাল ছোপ , তাই মনে মনে ওর নাম দিয়েছি সালু। দুপাশে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়েগেছে ছোট ছোট পাহাড় এদের মাঝ দিয়ে হেঁটে চলেছি নিচের দিকে , নামা টা বেশ সহজ তাই বেশ ভালো লাগছে , খালি মুশকিল হচ্ছে ঘাসের শিশির আর ভেজা মাটির জলে ভেজা জব জবে জুতো। মোজাও নেই বলে পা ভিজে যাচ্ছে , পা ভিজলেই নুন ধুয়ে যাচ্ছে , উফঃ আবার জোঁকের পাল্লায় পড়তে হবে। এবার চড়াই এ চড়তে হবে। GPS আমাকে সেই দিক এ নিয়ে যাচ্ছে , ভেজা ঘাসের ঢিপি গুলো তে চড়তে বেশ সময় লেগে যায়। এদিক টা খুব একটা ঝোপ ঝাড় ও নেই , খালি সবুজ ঘাস আর তার মাঝে সাদা আর হলুদ ছোট ছোট ফুল , বেশ সুন্দর জায়গা টা। এবার আমি আসল বিপদ এর গন্ধ টা পেলাম , কুয়াশা এসে পুরো জায়গা টা ঢেকে দিলো , আর সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। কোনো ছাওয়া বা বড়ো গাছ ও নেই আসে পাশে , ব্যাগ এ যদিও রেইন কোট আছে কিন্তু বসার জায়গা তো একটা চাই। ঘাসের ওপর বসা বিপদ , এতক্ষন পায়ে জোঁক কামড়েছে কিন্তু ভেজা ঘাসে বসলে জোঁক কোথায় কোথায় কামড়াতে পারে সেটা ভেবে শিউরে উঠলাম। একটা পাথর খুঁজে বার করতেই হবে , কিন্তু এতো কুয়াশা যে কিছু দেখা যায় না , যাই হোক কিছুক্ষন এদিক ওদিক করার পর একটা পাথর পাওয়া গেলো যেটা মোটামুটি শুখনো। রেইন কোট টা গায়ে চাপাতে গিয়ে মনে হলো সালুর কথা , বেচারা ভিজবে ? বুদ্ধি করে রেইন কোট টা পিঠের ব্যাগ এর নিচে গুঁজে দিয়ে, কোট এর মাথার দিক টা আমার মাথার ওপর দিয়ে সামনে নিয়ে এসে লাঠির মাথায় গুঁজে দিলাম , বেশ একটা ছাউনি হলো। সালু কে ডাকতেই ও আমার কোলের কাছে এসে বসে পড়লো। বৃষ্টি ও বেশ শুরু হলো , কি করা যায় খিদে মেটানোর জন্য ব্যাগ থেকে কলা আর ডিম সিদ্ধ বের করলাম , কিন্তু সালুর বিস্কুট তো শেষ। মনে হলো – কুকুরে কি কলা খায় না ?

13557800_215864822141917_3799557655015757375_n-1

কি জানি খেতেও পারে, মানুষের সঙ্গে তো ঘোরাঘুরি করে , আর কলা কি এমন খারাপ জিনিস। কলা ছাড়িয়ে সালু কে দেখিয়ে নানা অঙ্গ ভঙ্গি করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে এটা খাবার জিনিস। সালু নির্বিকার ভাবে কিছুক্ষন চেয়ে থাকলো বটে , মনে হলো – ও বুঝেছে ব্যাপার টা। আধখানা কলা দিলাম, সালু সেটা নানা ভাবে শুঁকে খেলো তো না বরং উঠে পড়লো। এদিকে বৃষ্টি টাও মোটামুটি থেমে গেছে কুয়াশা টা একটু কমেছে বলে ভ্যালি টা বেশ ভালো দেখতে লাগছে। দূর থেকে গরুর গলায় বাঁধা কাঠের ঘন্টার আওয়াজ আসছে টক টক করে।রেইন কোট গুটিয়ে উঠে পড়ার পালা কারণ বেশ কিছু টা পথ বাকি। বৃষ্টির জন্য ঘাস গুলো আরো ভিজেছে, কিন্তু দেখতে আরো ভালো লাগছে , এতো সবুজ তো দেখার সুযোগ হয় না। GPS এর বক্তব্য, আমি মাঘমার কাছাকাছি এসে গেছি , আমি এখন নেপাল এ , এই পুরো রুটে টাই ভারত নেপাল বর্ডার দিয়ে। এবার ডান দিক এর পাহাড় টা চড়লেই মেঘমা পৌঁছে যাবো , গরম চা পাবো 🙂. কিন্তু একটা সমস্যা আছে , এ পাহাড় টা ঠিক নেড়া ঘাসের ঢিপি নয় , এটাতে কিছু ঝোপ ঝাড় পাথর , ঠিক বুঝতেও পারছি না কোথা দিয়ে ওঠা যাবে। একবার ভাবলাম পেছনে ফিরে যাই , সহজ রাস্তা ধরে উঠে যাবো, আবার ভাবলাম একটা পাহাড় দেখে ফিরে যাবো? বিভূতিভূষণ এর শঙ্কর আফ্রিকা গিয়ে ফাটাফাটি করে এলো, আমি নিজের দেশে, নিজের স্টেটে একটা পাহাড় দেখে পালাবো ? কক্ষনোই না।

কিছুক্ষন পাহাড় টা তে হাঁচোড় পাঁচোড় করলাম, কিন্তু কিছুতেই সুবিধা হচ্ছে না , পাথর গুলো ভিজে আর তাতে শ্যাওলা, ঝোপ গুলো ধরে উঠতে গেলে নয় ডাল ভেঙে যাচ্ছে অথবা হাতে কাঁটা লাগছে। নিকুচি করেছে শঙ্কর এর, ও সব গল্প কথার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে লাভ নেই। চললাম ফিরে পেছন দিকে , বেশ কিছু টা ফিরে এসে একটা ঢালু পায়ে চলা রাস্তা ধরে উঠে পড়লাম পাথর বেছানো মেইন রোড এ। এ রাস্তা আমার চেনা, কিছুটা গেলেই মেঘমা।

13607009_215864908808575_3476162643928817892_n-1

মেঘমা একটা ছোট গ্রাম কয়েকটা মাত্র বাড়ি , এখানে মাদান তামাং এর বাড়িটা সব থেকে ভালো , মদন তামাং খুন হবার পর ওনার খিট খিটে দিদি এটি দেখাশোনা করেন। এর কোনো ফোনে নম্বর ও নেয়ার দরকার পড়েনি কারণ এ জায়গায় সেলফোনের সিগনাল ই থাকে না, আর তা ছাড়া মেঘমা তে কোনো ট্যুরিস্ট থাকে না তাই ঘর না পাবার টেনশন নেই। দুপুরে একটা ভাত ঘুম বাঙালীর – মানে অন্তত আমার তো খুব প্রিয় ব্যাপার 🙂 . মেঘমা জায়গা টা খুব ছোট, দু চার খানা দোকান আর কয়েকটা মাত্র বাড়ি ,একটা অনামী গুমফা। কিন্তু সত্যি এর নাম কেন মেঘমা হয়েছে সেটা এলেই বোঝা যায়। এতো মেঘের যাতায়াত এখানে , মাঝে মধ্যেই মেঘে ঢেকে গিয়ে সব সাদা। সন্ধ্যা অব্দি এখানে ঘোরাঘুরি করা মুশকিল, মাদান তামাং এর বাড়ির পাশে একটা ভারতীয় সেনার ক্যাম্প আছে. ওরা এক গাদা প্রশ্ন করে , গতবার আমাকে অনেক প্রশ্ন আর সন্দেহের মুখে পড়তে হয়েছিল। কাঁহা সে আয় ? কিঁউ আয়া ? একেলা কিঁউ ? ইধার কিঁউ বৈঠা ? ID দিখাও। রুকো সাহেব কো দিখাকে আতা হ্যায় । এর পর ফিরে এসে বলে সাহেব বোলা জাদা দিন নেহি রাহেনা কিঁউ কি আপ একেলা হয় , ইস টাইম মে তো আইস্যা নেহি আতা হ্যায় । যা বাবা কি জ্বালা রে , কিন্তু সেনা বলে কথা , ওদের সঙ্গে ঝগড়া করতে আমার ভয় লাগে , হাতে বড়ো বড়ো বন্দুক। যাকগে ঘরে গিয়ে বসে বসে ভ্যালি তে মেঘের খেলা দারুন লাগে আর তার সঙ্গে আমার কাছে লিকর শপ থেকে আনা প্রয়োজনীয় জিনিস তো আছেই। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে বললাম চল বেটা ঘরে 🙂 . কাল সকালে তো ফেরার পালা।

13599878_215864808808585_5615389040387706082_n-1

আলাদিনের জীন

আলাদিনের জীন

আলাদিনের প্রদীপের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা জীনটার মতোই কুঁড়ে এবং বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে বা দিবা স্বপ্ন দেখে কাটাই। অভ্যাস বসত আমাকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার কারণে মাঝে মধ্যেই ঘর ছাড়া হতে হয়। আমি ঝোলা কাঁধে নিয়ে একাই অনেক জায়গা ঘুরে বেড়াই। আমি সাহিত্য জানিনা তাই যা চোখে দেখি আর যে সব উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসে সেগুলোই টুকলি মারি।

More Posts

Related posts

Leave a Comment