আমরা যখন বড়ো হচ্ছিলাম, তখন প্রায়শই চারিদিকে ঘটি আর বাঙালদের বাক্ যুদ্ধ শুনতে পেতাম।এখন তো সে সব অতীত।এখন ঘরে ঘরে বাটিদের বাস।আমরা ছিলাম শুদ্ধ ঘটি, বাড়িতে প্রায়ই একটা কথা শুনতে পেতাম, “ওরা তো বাঙাল, ওদের কথা বাদ দে তো!” কিন্তু কেন যে বাদ দেবো , সেটা বুঝতাম না। সল্টলেকে আমার জন্ম না হলেও মোটামুটি জ্ঞান হওয়া থেকে ওখানেই থাকি,আমাদের আশপাশের প্রায় সবাই বাঙাল, পাড়ার বন্ধু, স্কুলের বন্ধুর বেশির ভাগই বাঙাল। যার ফলে অবচেতন মনে আমার বাঙাল প্রীতি তৈরি হয়ে গেছিল। চিরকালই আমি খুব খাদ্যরসিক মানুষ, যারা আমায় অল্প চেনে তারাও জানে।আর এই গুন বা দোষটা থাকার জন্য আমার বাঙাল প্রীতি প্রবল ছিল।বন্ধুদের বাড়ির রান্না আমার অসাধারণ লাগত।মাকে বললে ,মা বলত ” ওদের দেশে কিছু পাওয়া যেত নাকি? কচু ঘেচু শাক পাতা যা পায়, তাতেই লঙ্কা আর গাদাগাদা তেল দিয়ে রান্না করে।” বন্ধুদের সে কথা বললে মোটামুটি রায়ট লেগে যেত। ওরাও কেন ছাড়বে! বাড়ি থেকে শিখে এসে বলত ,” ঘটিরা আবার রান্না পারে নাকি? সব কিছুতেই আলু আর চিনি দিয়ে দেয়।” একদম হক কথা।আমি চুপ করে যেতাম। বাড়ি গিয়ে হয়ত দাদাকে বললাম,বন্ধুদের ঝগড়ার কথা ,(যতই রান্না ভাল লাগুক ,হেরে যেতে কারই বা ভাল লাগে?) দাদাতো লম্বা একপাতা ফর্দ শুনিয়ে দিত, তার মধ্যে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানও থাকত।আমি ভাবতাম এইবার গিয়ে বন্ধুদের ভাল করে শুনিয়ে দেব,কিন্তু হায় ! যখই বলতে গেছি, দেখতাম সব উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে হয়ে গেছে। একবার এক বন্ধু বলল , ওর মা কপিপাতা বাটা বানিয়েছে, আর সেটা নাকি অসাধারন খেতে হয়েছে। আমার খাদ্যরসিক জিভ লকলক্ করে উঠল।বাড়িগিয়ে মাকে মনের ইচ্ছে জানালাম , ব্যাস! মা রেগে মেগে বলল” কপির পাতাটাকেও ছাড়বে না ওরা? আলুর খোসা,মাছের আঁশ সব কিছু খেয়ে নেয় ওরা, তা বলে তুইও ওই সব ছাইপাঁশ খেতে চাইবি?” এখনোও আমার সে সাধ পূরণ হয়নি।কেউ যদি কপিপাতা বাটা রাঁধতে পার, তো প্লিস্আমায় খাইও।আমার মা খুব ভাল রাঁধতে পারে, কিন্তু ছোটবেলায় মনে হত বন্ধুর মায়েরাই বুঝি ভাল রাঁধেন ।এখন আমার মেয়ে যখন বলে “মা শগুন কি ভাল রুটি আর আচার আনে।” তখন আমি আমার শৈশবকে মনে করি।
আমাদের বাড়ির পাশে এক জ্যাঠিমা থাকত, মানে পাড়াতুত আর কি, কি যে ভাল তক্তি বানাত ,সে বলে বোঝাতে পারবনা।তক্তি জিনিসটির সাথে সবার মনে হয় পরিচিতি নেই।নারকেলকে ঝুরোঝুরো করে কেটে (এতটাই মিহি যে হাতকেটে যেত জ্যাঠিমার) গুড় দিয়ে পাক দিতে হত,আর সবথেকে মজার লাগত তার আকার! হাঁস, পাখি কত রকম আকারের হত। মুরির কৌটোয় রেখে দিত সে তক্তি, মচমচকরত কামড়ালে ।সেই রকম তক্তি আর কখনও খাইনি। ওই জ্যাঠিমাও বাঙাল ছিলেন।
আর একটা খাবারের কথা না বললেই নয়, আমার এক বন্ধুর মা অসাধারন একটা খাবার টিফিনে দিত ওকে। সিমাই,নারকেল, চিনি, দিয়ে একদম শুকনো শুকনো একটা খাবার,নাম জানিনা কী, কিন্তু এখনও যেন মুখে লেগে আছে।ওই রকম মিষ্টি ন্যুডলস্ আর কোথাও খাইনি।এই কাকিমাও কিন্তু পূর্ব বঙ্গের।
দাদার যখন বিয়ে ঠিক হচ্ছিল , আমাদের বাড়ির একমাত্র শর্ত ছিল , মেয়ে যেন বাঙাল না হয়, বাঙাল মেয়েরা নাকি খুব মুখরা হয়। আর আমার মনের কোনে ইচ্ছে ছিল , বৌদি যেন বাঙাল হয়, সুস্বাদু রান্না খাওয়ার লোভে। বৌদি ঘটিই হয়েছে, কিন্তু আমার ইচ্ছেও অপূর্ণ থাকেনি, বৌদির হাতের রান্নাও অপূর্ব ।
এক মধুর ইকুয়েশন ছিল বাঙালির জীবনে বাঙাল আর ঘটির।চিংড়ি -ইলিশ ,পোস্ত -কচু , ইস্টবেঙ্গল – মোহনবাগান, ঝগরুটে – মিচকে শয়তান ,এমন কি রবীন্দ্রনাথ -শরৎচন্দ্রকেও ছাড়ত না ।কতকিছু নিয়েই না দুপক্ষের যুদ্ধ চলত। আর এখনকার যুগের ছেলেমেয়েরা তো জানেই না বাঙাল ঘটির এই অম্লমধুর সম্পর্ক। তবে এখনও ওরা আমরা আছে। নতুন ভাবে।বাঙাল আর ঘটি মিলেমিশে শুধু বাঙালি হয়ে গেছে। উল্টো দিকে জায়গা করে নিয়েছে মারয়ারি। মারুদের কাছে বাঙালি মানে কথায় কথায় ঝগড়া করা , নোংরা, মাস-মাচ্ছি খানেবালা জাতি। আর বাঙালিদের কাছে মারুরা ? আনকালচার, নারীকে সন্মান দিতে না পারা , সব কিছুকে টাকায় হিসেব করা, বাচ্চাদের ভাল করে মানুষ করতে না পারা ,এক জাতি হল মারয়ারি।আমার আবার মেয়ের স্কুলের , পাড়ার ,সব বন্ধুরা মারু। ও আমার মত বন্ধুদের খাবার দাবার খুব পছন্দ করে।হিন্দিতে কথা বলতে পছন্দ করে।আজকাল আবার নিরামিষ খেতেও খুব পছন্দ করছে। কে জানে , মেয়ে যখন বড় হবে তখন হয়ত বাঙালি আর মারয়ারিও মিশে যাবে ।প্রশ্ন একটাই ,তখন ওরা আমরা কাদের নিয়ে হবে?