আশ্রয়

(১)

বাসমতী চালের ভাত, মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল, ঝিরিঝিরি আলুভাজা, ধোকার ডালনা, দই পনীর, রুই মাছের কালিয়া, মুরগির মাংস আর চাটনি – এই ছিল আজকের মেনু।গতকাল ডাল, মাছ আর ধোকা করে রেখেছে। ফ্রিজ থেকে বের করে সবজি রাখা টেবিলের উপর; প্রায় ১১টা বেজে গেছে। স্নানভেজা চুলে তোয়ালে জড়িয়ে তাথৈ ভাবছিল কি করা উচিত তার। সকাল থেকে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে, মাথাটাও একটু ব্যাথা ব্যাথা করছে।এখন খুব ইচ্ছে করছে শুয়ে ঘুমতে – যা হয় হোক! এই ভাবনাটা এলেই আবার মনে হচ্ছে, বিকেলে কতজন আসবে, তাদের কি করে বারণ করবে?অনিচ্ছাসত্বেও বঁটি নিয়ে সব্জি কাটতে বসতে গিয়ে দেখল, বসা যাচ্ছে না, যন্ত্রনাটা আবার জাগছে। অগত্যা, টেবিলে ছুরি নিয়ে কাটতে বসল। টোম্যাটোটাকে কাত করে মাঝখান থেকে ছুরি চালাতে চালাতে হঠাৎ একটা চিন্তা এল তার – টম্যাটোটা যদি কারোর গলা হয়, সে কি এইভাবেই অনায়াসে কাটতে পারবে??

বিছানায় ফোনটা রাখা ছিল। তাথৈ ফোনটা তুলে দ্যাখে ২৮ খানা মিসড কল, এর মধ্যে ১১ খানাই কালাচাঁদের। বাকিগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়ই শুভেচ্ছাবার্তার জন্য ছিল।  চোখ বন্ধ করে মিনিট খানেক ভাবল তাথৈ, তারপর কলব্যাক করল।

-বল

-কোথায় ছিলি তুই? এতবার কল করছি……সারাক্ষন ধরে প্রেম করছিস নাকি? অন্য কাজ কম্ম নেই?

-বাজে কথা ছাড়।

-শোন, অফিস থেকে হাফছুটি নিচ্ছি, বিকেল ৪টের মধ্যেই পৌঁছে যাব। ঠিকমতন অতিথি সৎকার করিস। বৈ দাকে বলিস, শ্বশুরবাড়ির লোক আসছে, ভালমতন খাতিরদারি না করলে কিন্তু সব রিপোর্ট হয়ে যাবে।

তুই প্লিস আজ আসিস না। প্লিস।

-রাগ করছিস ক্যানও…আরে ছুটি নিতে পারলাম না রে। নতুন জয়েনিং তো।

-কালা, প্লিস, একটু বোঝার চেষ্টা কর, আসিস না তুই এখানে, আর…..আর কোনোদিন আমায় ফোন করিস না, আমার সাথে যোগাযোগ রাখিস না। তোর বন্ধু মরে গ্যেছে, ভেবে নে।

-কি রে…. কি ব্যাপার বল তো? সিরিয়াস মনে হচ্ছে!! ওয়েট, দেখছি, কত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়, গিয়ে কথা হবে!!

হায় রে তাথৈ, কি ভাবে বোঝাবি তোর পাগল বন্ধুকে যে ওর জন্যই তোর প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে তোর বর তোকে কি দারুন উপহার দিয়েছে, প্রায় সারারাত একরকম পাশবিক শারীরিক অত্যাচার এবং সকালে বেরোবার সময় বলে গেছে আজ বাড়ি ফিরবে না।।

-কালা, শোন, তোর জন্য যে আমার সংসারটা ভাঙতে বসেছে রে, আসিস না তুই, আমায় ভুলে যা। যদি পারিস, আমায় ক্ষমা করে দিস।

-কি বলছিস কি রে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না রে, আমার জন্য তোদের মধ্যে অশান্তি!!

-আমিও ভাবতে পারি নি রে। প্লিস বন্ধু, আসিস না, ভুলে যাস আমায়।

-তাথৈ, তোর গিফটগুলো আমায় দিয়ে যেতে দে, তোর জন্য কত চকলেট কিনেছি রে,

-আমার নাম করে স্টেশনের ভিখারি বাচ্চাগুলোকে দিয়ে দিস। আমায় ভুলে যা, ভাল থাকিস। আর, আরেকটা কথা, বাবা-মা কে কিছু জানাস না। তোকে বিশ্বাস করি, এই বিশ্বাসটা প্লিস রাখিস।

-তাথৈ, শোন…. একটা কথা….

-রাখছি, ভাল থাকিস।

ফোনটা রেখে নিজেকে সামলাতে পারে না তাথৈ, খুব বাবা-মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে তার। কতদুরে বাবা-মা; বালিশটাকে জড়িয়ে মা গো, আমায় নিয়ে যাও তোমার কাছে…. বলে কাঁদতে কাঁদতে সে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।

(২)

চোখ খুলে পরমা দ্যাখে, সে হাসপাতালের বেডে, সামনে মা দাঁড়িয়ে। ডাক্তারবাবু পাশ থেকে বলেন, “ম্যাডাম, ভগবান কে ধন্যবাদ দিন, প্রান ফিরে পেয়েছেন। মায়ের সাথে কথা বলে নিন, বাইরে পুলিশ ওয়েট করছে, আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চায়”। তারপর সিস্টারকে ইন্সট্রাকশান দিয়ে বেরিয়ে যান। ঠোঁট নেড়ে অস্ফুট স্বরে ধন্যবাদ জানায় ডাক্তারকে।

পরমা অনুভব করে তার মাথায় আর বাঁ হাতে ব্যান্ডেজ । মা গালে হাত বুলিয়ে দেয়, ভালো লাগে।

সিস্টার  – “বেশি কথা বলবেন না” বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।

পরমার মনে পড়ে যায় সবকিছু….. মা গো, তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করো নি, দেখলে তো, কি হতে চলেছিল, খুব আস্তে আস্তে কথাগুলো বলে সে।

বাসবী দত্ত মেয়ের মাথার ব্যান্ডেজে হাত রেখে বলেন, সব বুঝি রে মা। যা হয়েছে তোর সাথে , তা ক্ষমার অযোগ্য; তাও একটা অনুরোধ করছি, নব্যেন্দুকে ক্ষমা করে দে, ও তোর মেয়ের বাবা, মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে অন্ততঃ………

পরমার দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সে ভেবেছিল, এইবার হয়তো বাবা-মা তার পাশে থাকবে।

পুলিশ ইনস্পেক্টর দরজায় নক করে অনুমতি নেয় ভেতরে আসার, মায়ের দিকে চোখ যায় পরমার, মা হাত জোর করে দাঁড়িয়ে।

ছোটবেলা থেকে স্বপ্নবোনা মন আজ এক অলীক গল্প বোনে, পুলিশ শোনে, বাইক থেকে সে নিজেই ব্যালেন্স না রাখতে পেরে পড়ে গেছে। পুলিশ বার বার করে জিজ্ঞেস করে, রাস্তার লোকজন সাক্ষ্য দিয়েছে যে তাকে ইচ্ছে করে ফেলে দেওয়া হয়েছে, সে পড়ে যাওয়ার পরেও বাইক না থেমে চলে যাচ্ছিল এবং রাস্তার লোকজন বাইক থামিয়ে চালককে ধরে। পরমা সে দাবী নস্যাৎ করে বলে যে সিনথেটিক শাড়ি পড়ে থাকায় সে নিজেই নিজের দোষে এই অ্যাকসিডেন্ট ঘটিয়েছে। নব্যেন্দু নির্দোষ প্রতিপন্ন হয়, দত্ত দম্পতি নিশ্চিন্ত হন।

সিস্টারের কাছে জানতে পারে পরমা যে তার হাত ভেঙ্গে গেছে, ঠিক হতে মাস তিনেক লাগবে। মাথার চোট বেশি নয়, পাঁচটা স্টিচ পড়েছে, খুব ভাগ্য ভাল তাই চোখ বেঁচে গেছে।

বেডে শুয়ে শুয়ে পরমা ঠিক করে নেয় তার পরবর্তী পদক্ষেপ। মেয়েটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কালকে নিয়ে আসবে বলেছে। নব্যেন্দু এখনও ওর সামনে আসতে পারে নি। মন থেকে ও নিজেও চায় না ওই মুখদর্শন করতে। সমস্ত ঘটনাটা কি নির্ভুলভাবে ঘটাতে চেয়েছিল লোকটা!!

(৩)

কফি হাউসে বসে রাগে ফুটছিল বৈদূর্য। কোনও সময়জ্ঞান নেই মেয়েটার। সারাক্ষণ হৈ হৈ করে বেড়ানো, জগৎসংসারের সমস্যা দূর করার ভার সে নিজেই একার ঘারে নিয়ে ফেলেছে। বৈদূর্যর যেন তার কাছে আলাদা কোনও গুরুত্বই নেই।

প্রায় মিনিট কুড়ি বাদে তাথৈ এল নাচতে নাচতে, মুখে একগাল হাসি, ভাবখানা এমন যেন সারা পৃথিবী জয় করে এসেছে। বেচারি বোঝেও নি যে অগ্নুৎপাত অপেক্ষা করছে তার জন্য।

চেয়ার টেনে বসতে না বসতেই গাদা গাদা অভিযোগের তীর এসে বিদ্ধ করল সেই হাসিমুখকে; ঠোঁটের কার্ভটা বদলে গেল, গাল ভিজে গেল জলধারায়। নিজেকে এইভাবে বারংবার ক্ষতবিক্ষত হতে দেওয়াও বোধহয় একরকমের ভালোবাসা।

এইরকম ব্যথাগুলোর উপশম হত একলা ফ্ল্যাটে গোপন অভিসারে। তাথৈ নিজেকে উজার করে দিত বৈদূর্যর কাছে।ওমের উষ্ণতা সব অভিমান মুছিয়ে দিত।

একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে দিয়ে তখন সময়টা যেত। বাড়ির অশান্তি থেকে বেরোবার একমাত্র পথ সে পেয়ে গেছে। যাকে সে নিজের সবটুকু উজার করে দিয়েছে, তার সাথেই বাসা বাঁধবে সে। বাউন্ডুলীর মনে গেরস্থালির স্বপ্ন আসে।চোখ বন্ধ করে দেখতে পায় সে বেতের আসবাবে সাজান একটা ছোট্টো ঘর, একরঙা সুতির পর্দা জানলা থেকে আসা রোদের রঙ বদলাচ্ছে , নিজের হাতে তার মনের মানুষটার জন্য সে শুক্ত, পোস্ত, লইট্যা মাছ, লাউ চিংড়ি রান্না করছে; ভারি ভালবাসে যে সে এইসব।

বৈদূর্যর হাতের ক্যাপ্সটানের গন্ধটা সাংঘাতিক নেশা ধরায়। সেদিন অটোতে যেতে যেতে একজনের থেকে এই গন্ধটা পেয়েছিল সে। নেশার জোর এমন যে, তক্ষুনি তার মনে হয়েছিল বৈদূর্যর সাথে দেখা করতেই হবে। লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে সে তার অফিসে গিয়ে হাজির হয়েছিল। অফিসের ফায়ার এক্সিটের সিঁড়িতে বৈদূর্যকে এনে চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিল।

সমবয়সী অনুরাগীদের কোনোদিনই পাত্তা দিত না তাথৈ; কিন্তু একগাল দাঁড়িওয়ালা, পাঁচ বছরের সিনিয়র বৈদূর্যকে কলেজের ইউনিয়ন রুমে দেখেই ভাল লেগে গিয়েছিল। একটু আঁতেল টাইপ, পাঞ্জাবী পড়ে, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝোলে আর সাথে লিডার লিডার ভাব – কম্বিনেশানটা তাথৈকে ইমপ্রেস করার জন্য যথেষ্ট ছিল। অসীম সাহসে নিজে যেচে আলাপ করার পর, দেখা হওয়াটা নিয়মিত হয়ে গেল। ক্রমে ক্রমে লাগামছাড়া ঘনিষ্টতা বিয়ের পিঁড়ি ছুঁল। তাথৈয়ের ষষ্ঠেন্দ্রিয় বহুবার বাধ সেধেছিল, কিন্তু ওই যে, ভালবাসার মায়াজালে জড়ালে কে আর কার কথা শোনে…..

একদিন হাসতে হাসতে খোলা মনে তাথৈ বৈদূর্যকে কৃষ্ণেন্দুর পাগলামির গল্প করেছিল;  সে বলেছিল, পাগলা কৃষ্ণেন্দু কি ভাবে ১০৮ বার ওর নাম লিখে জন্মদিনে প্রেসেন্ট করেছে। এই সৃষ্টিছাড়া, নিয়মহারা, হিসেবহীন কৃষ্ণেন্দুকে ভাল লাগে তাথৈয়ের। ওর বোকা বোকা কাজকম্মগুলোতে নিজের ছোটবেলাটা খুঁজে পায় সে।তাথৈ বুঝত কৃষ্ণেন্দু ওকে পছন্দ করে; কিন্তু তাথৈ বন্ধুত্ব হারাতে চায় নি, সে যে বৈদূর্যর – তা জানিয়ে দিয়েছিল। ফলস্বরুপ কৃষ্ণেন্দু হয়ে ওঠে তাথৈএর কালাচাঁদ আর এক প্রানের থেকে প্রিয় বন্ধু।তাথৈয়ের এই বন্ধুকে বৈদূর্য যে কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি, উপরন্তু, সারাক্ষণ ধরে মনে পুষে রেখেছে এক নোংরা সন্দেহ – সেটা গত রাতে তাথৈ উপলব্ধি করে হাড়ে হাড়ে।

(৪)

চিঠি লেখা শেষ করে সেটাকে পরমা টেবিলের উপর জলের বোতল চাপা দিয়ে রাখে। সোনার গয়নাগুলোকে রুমাল ও শাড়িতে ভাল করে বেঁধে সুটকেসের নিচের দিকে জামাকাপড়ের মধ্যে গুছিয়ে নেয়। বাড়ি থেকে বেরনোর আগে শুধু দরজা সরিয়ে শাশুড়ির পাশে শুয়ে থাকা নোঙরকে দেখে।তিনবারের চেষ্টায় পাওয়া তার ছোট্ট নোঙর; নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে…… ভালো থাকিস মা, আমার কাছে যেদিন যেভাবে আসতে চাইবি, আসিস। দু হাত মেলে জড়িয়ে ধরব। যে আশ্রয় আমি পাই নি, সে আশ্রয় আমি তোকে দেব –মনে মনে বলে, টপ টপ করে করে পড়া জল আঁচলে মুছে শেষবারের মতন উঠোন ডিঙায় সে।

ট্যাক্সি নিয়ে শেয়ালদা যেতে যেতে ভাবতে থাকে পরমা। নব্যেন্দুর সাথে আলাপের পর প্রান পেয়েছিল সে। মনে হয়েছিল, এই মানুষটাকে যেন ভগবান তার জন্যই তৈরি করেছে। তারপর হঠাৎ করে সিন চেঞ্জ হয়, হাস্পাতালের বেডে পরমা, প্রথমবার মা হবার অনুভুতি, বাচ্চাটাকে ঠিকমতন দেখতেও পায় নি। বিকেলে একবার শুধু পাশে শোয়ান হয়েছিল। সকালবেলা জানা গেল সে আর নেই। এই দোষ কি তার ছিল? তার মনের অবস্থা কেউ বুঝল না, নব্যেন্দুও কত কিছু বলেছিল তাকে। বাবা-মা কে কখনওই সে পাশে পায় নি, এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। শাশুড়ির কথায় সে তারাপীঠে এসে গোপাল ঠাকুরের কাছে দীক্ষা নেয়। গোপাল ঠাকুরকে নিজের বাবার মতন মনে হয় পরমার; ফিজিক্সে ডক্টরেট একজন এই শ্মশানে এসে ছাইভস্ম মেখে সাধনা করে চলেছে। ভাল থাকার কত রকমের সহজ উপায় বলেছিল পরমাকে। পরমা একবুক অক্সিজেন নিয়ে কলকাতায় এসেছিল, নব্যেন্দুকে নতুন ভাবে জীবনে আপন করে নিয়েছিল। নব্যেন্দুর নেশা করে গালমন্দ করা, গায়ে হাত তোলা, অন্য রমণীতে আসক্তি…… সবকিছুকেই মেনে নিয়ে নতুন শুরু করেছিল সে।

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে এত ভোরেও জ্যাম! গুচ্ছের লরিগুলো সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। জলের বোতলটাই আনতে ভুলে গেছে পরমা। সিটে মাথা হেলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে আবার সিনেমা চালু হয়। সেই পিশাচটার কথা মনে পড়ে গেল। পরমা পুনরায় প্রেগন্যান্ট হয় এবং সাত মাসের মাথায় তার গর্ভপাতও হয়ে যায়। মনে চাপ থাকলে শরীরেও যে চাপ পড়ে; এইবার সে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায় – এবারেও যে তার দোষেই ঘটনাটা ঘটল। সে তো সত্যি অপয়া, মা হওয়ার ক্ষমতাই নেই। বসু দম্পতি নব্যেন্দুর বাড়ি এসে হাত জোর করে ক্ষমা চায়, তারাও মনে করে, এই বাড়িতে পরমার মতন মেয়ের স্থান পাওয়া অনুচিত। এক সপ্তাহ পরে বাসবী দত্ত নব্যেন্দুর মায়ের অনুমতি নিয়ে পরমাকে নিয়ে যায় এক তান্ত্রিকের কাছে, যার প্রসাদে বাঁজা মেয়ের বাচ্চা হয়। পরমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের  উপর আর কারোর নজর নেই, সে এখন সুস্থ সন্তান উৎপাদনে অক্ষম এক যন্ত্র যাকে মেরামত করানোর জন্য মেকানিকের কাছে আনা হয়েছে। সেই মেকানিক পরমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে পুত্রসুয় যজ্ঞ করার নাম করে দরজা বন্ধ করে পরমার ব্লাউজে হাত ঢোকায়, পরমা চিৎকার করার উপক্রম করলে বলা হয়, গায়ে অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হবে। পরমা গোপাল ঠাকুরকে স্মরণ করতে থাকে।  পিশাচটা তার শাড়ি খুলতে গেলে সে ঊর্ধশ্বাসে দরজা খুলে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। নিজের মা কে তার বলার আর কিছুই ছিল না, শাশুড়ির পায়ে কেঁদে পরে শুধু আশ্রয় চায়। সে রাতে নব্যেন্দু আসে, জানিয়ে দেয় যে পরমাকে এবাড়িতে থাকতে হলে কাজের লোকের মতন থাকতে হবে। পরমা রাজি হয়, তার জন্য বরাদ্দ হয় ভাঁড়ার ঘরটা। জিনিসপত্র সরিয়ে একটা চৌকি আর একটা আলমারির ব্যাবস্থা করা হয় দয়া করে। আর নব্যেন্দু তার বান্ধবীকে নিয়ে আসতে থাকে রাতের বেলা। এমনি একরাতে নেশার মেজাজ শরীরের খোঁজে ভাঁড়ার ঘরে ঢোকে। দয়ার আশ্রিতার বিরোধের পথ থাকে না। সেইরাত পরমাকে নোঙর উপহার দেয়। পরমা বিশ্বাস করতে পারে যে সে এক সুস্থ্ সন্তানের জন্ম দিতে পারে। একমাথা ঝাঁকড়া চুলের ছোট্ট নোঙর, তার সবটুকু ভালো দিয়ে তৈরি।

(৫)

গণনাট্য দলে অভিনয় করা অভিজ্ঞতা কাজে লাগায় তাথৈ। বিছানা থেকে উঠে, স্পিকারে ফোন রেখে মিসড কলগুলোর উত্তর দিতে দিতে রান্না শেষ করে। সন্ধ্যের আগেই নতুন শাড়ি পড়ে সেজে গুজে সে রেডি নিজের প্রথম বিবাহবার্ষিকী পালনের জন্য।বেকারি থেকে অর্ডার দেওয়া কেক এল। নিমন্ত্রিতরা এলেন হাত ভর্তি উপহার নিয়ে আর গেলেন মনে এক গভীর প্রশ্ন নিয়ে।তাথৈ আতিথেয়তায় ত্রুটি রাখেনি কোনও, কিন্তু বৈদূর্য যে কোথায়, এই প্রশ্নের উত্তরও সেভাবে কাউকেই দেয় নি। সে ঠিক করেছে, তার আচরণে ভব্যতা, যেটা সে তার বাবা-মা র কাছ থেকে পেয়েছে, তাকে বজায় রাখবে, কিন্তু, অভব্যতাকে প্রশ্রয় সে আর দেবে না। লোকজনকে বাড়িতে ডেকে , নিজে না থেকে আসলে ছোটটা কে হল! তাথৈ নিজেকেই দুষছিল, এইভাবে যদি সে আগে ভাবত, তাহলে কেঁদে কেঁদে এতটা সময় নষ্ট হত না।

গিফটের র‍্যাপগুলো খুলতে খুলতে তাথৈ ভাবল, সে আবার চাকরি খুঁজবে। অনেক খরচ করে সে পড়াশোনা করেছে, সেই সময়গুলোকে আর ব্যার্থ হতে দেওয়া যায় না।আফসোস পাহাড় প্রমান।যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে নিশ্চয়ই পেট চালানোর মতন কিছু না কিছু কাজ পেয়েই যাবে । দিল্লি তার অচেনা শহর, তবে এই শহরই তাকে রাস্তা দেখাল। একবার ভাবল কালাচাঁদকে ফোন করবে। তারপর ভাবল, নাঃ, থাক!যদি কপালে থাকে, ওর সাথে আবার দেখা হবে।

বামপন্থী পরিবেশের মধ্যে বড় হওয়া তাথৈ অনেক ছোটবেলা থেকেই দাম্পত্য হিংসার কথা জানে। সে হিংসা তো শুধু শারীরিক নয়, দাম্পত্য যাপনের মানসিক যন্ত্রণা কি মাপা যায় কখনও? দিনের পর দিন বিছানায় ধর্ষিত হওয়া, কথার উত্তরে মিথ্যে পাওয়া, ক্রমে ক্রমে নিজস্বতাকে বিসর্জন দেওয়া এবং ভাবতে শেখা –“আমি একটা বিগ জিরো, কোনও কম্মের নই, আমায় বিয়ে করাটাই ভীষণ ভুল…” এ জীবন কি সম্মানের? এ জীবন কি বাঁচা যায়!! তাথৈয়ের স্তনে সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগটা তার স্বামীর প্রেমের নিদর্শন।

তাথৈ কল্পনাও করতে পারে নি যে তার ভালোবাসা এমন পরিনতি উপহার দেবে। একটা অদৃশ্য চোখ সারাদিন তাথৈকে ফলো করে চলে। সবকিছুকে হিসেবে মেপে করতে হয়। সে যদি ফোন করে, ফোন ধরতে দেরি হলে এক রকম সন্দেহ, ফোন যদি ব্যস্ত থাকে, আরেকরকম সন্দেহ, আবার সাথে সাথে ফোন ধরলেও শুনতে হয়….”ফোন নিয়ে বসে আছো যে, কার ফোনের ওয়েট করছ?”

সেদিন ফেরেনি বৈদূর্য। পরেরদিন সকালে ফিরল হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে। অনেক কিছু বলছিল- কিছু কিছু ভালবাসার কথা- কিছু কিছু পরিতাপ আর অনেকটা নিজের কাজের এক্সপ্ল্যানেশান। একটা রাত তাথৈকে বদলে দিয়েছে। তাথৈয়ের মুখের হাসিটা যে মুখোশ, বৈদূর্য বুঝতে পারল না।

রান্না ঘরে খুন্তিনাড়া তাথৈকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বৈদূর্য তার কানটা চাটতে শুরু করল। তাথৈ চোখ বন্ধ করে নিজেকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই প্রথমবার তাথৈ যেন ব্যবসায়ী হয়ে পড়ছে, ভাবছে কি করলে এখন তার লাভ। দিয়ে দেয় নিজেকে বৈদূর্যের কাম চরিতার্থে। গত রাতের চোট এখনও তাজা। কিন্তু একটা শরীর, কিছু মাংসপিণ্ড আর কোনওদিন গভীর হৃদয়ের খোঁজ দেবে না।

এটাও বোধহয় ভালোবাসা, আঘাত খেতে খেতে সয়ে যেতে পারলে ভাল, নতুবা আঘাতের তীক্ষ্ণ ফলা যদি একবার মর্মভেদ করে, তখন ভালোবাসা আর কাছে টানে না, দূরে ঠেলে দেয়…অনেক দূরে।

তাথৈ এর এখন একটাই লক্ষ্য, এখান থেকে বেরোনো।

(৬)

জপ করার পর আসন থেকে উঠতে উঠতেই পরমা শুনতে পেল –‘বড়দি, বাবা ডাকছেন তোমায়’। আসন গুটিয়ে, কুলুঙ্গিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে বাবার ঘরে গেল সে।

-শোন মা, কালকেই মেয়েটি চলে আসছে। তোর ঘরেই একটু কষ্ট করে রেখে দিস।

পরের দিন সকালে দুটো বিশাল ব্যাগ নিয়ে মেয়েটি এল। দেখেই ভাল লাগল পরমার। নিজের ছোটবেলাটা মনে পড়ল। ভীষণ ছটফটে মানুষ, খুব কথা বলে আর হাসে।

এখানকার ‘হাসিখুশি’ স্কুলের পরমা হেড দিদিমণি। এইস্কুলেই এই নতুন দিদিমণি এসেছে ইতিহাস-ভূগোল পড়াতে।

৬জন অনাথকে নিয়ে দু বছর আগে গোপাল ঠাকুর শুরু করেছিলেন এই স্কুল। ভক্তজনের অনুদানে এই স্কুল বড় হয়েছে, আজ প্রায় ২২ জন মা-বাবাহীন জীবনকে স্বপ্ন দেখানো ও স্বপনপুরনের দায়িত্ব নিয়েছে ‘হাসিখুশি’।

-বড়দি, চাদর পাততে গিয়ে তোষকের নিচে একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি দেখলাম; কে গো?

পরমা হেসে উত্তর দেয়, – নোঙর।

-বাহ! ভারি সুন্দর নাম তো। কে গো এই নোঙর?

– আমার মেয়ে।

এরপর আর প্রশ্ন আসে না।

রাতে শুতে শুতে পরমা বলে, মনে প্রশ্ন রেখে দিন শেষ করো না। যা জানতে চাইছ, শুনবে?

তাথৈ চমকে যায়। বড়দি কি মন পড়তে পারেন? নোঙরের ছবি দেখে হাজার প্রশ্ন তার মনে ভিড় করেছিল। বড়দির মেয়ে কোথায়? বড়দি কেন মেয়েকে ছেড়ে এখানে আছে? প্রথমদিনেই নির্লজ্জ হয়ে এইসব জিজ্ঞেস করতে বিবেক বাদ সাধছিল।

এই আশ্রমে তাথৈ প্রথম আসে তার পিসির সাথে। বৈদূর্য যেদিন ওর বাবা-মাকে অসম্মান করে কথা বলে, সেদিন আর তাথৈ থাকতে পারে নি; এর আগে, রেগে গায়ে হাত তোলাকেও সে সহ্য করে নিয়েছিল। সেদিন এক কাপড়ে সে বেরিয়ে আসে। কাউকে আর সে পরোয়া করে না। ফোন করে কৃষ্ণেন্দুকে। একরাত কৃষ্ণেন্দুর ফ্ল্যাটে থাকে, এক ভালবন্ধুর সাহচর্য তাথৈকে মনের জোর দেয়। কৃষ্ণেন্দুই প্লেনের টিকিট কেটে দেয়, সি অফের সময় বলে যায় – আমি আছি, যেমন ছিলাম। আমি থাকব, যেমন ভাবে চাস। সত্যি!, তাথৈ উপলব্ধি করে, জীবন সুন্দর, সবকিছুর একটা ব্যালেন্স আছে। এই আশ্রমে এসেই তাথৈ এক অন্যরকম রোমাঞ্চ অনুভব করে। কি স্নিগ্ধ পরিবেশ, কি সিম্পল মানুষজন, সবার মুখেই একটুকরো হাসি লেগে আছে। গোপাল ঠাকুর যেন সাক্ষাৎ দেবাবতার। কথা যখন বলছিলেন, মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে দৈববাণী হচ্ছে। কি শান্ত এবং জোরাল উপস্থিতি। এইখান থেকে গিয়ে তাথৈ কিছুতেই শহুরে পরিবেশ মানাতে পারছিল না। মা-বাবাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে, গোপাল ঠাকুরকে হাসিখুশিতে পড়াবার অনুরোধ করে, চলে আসে এখানে।

-দিদি, ভুল বুঝো না গো। অমন ফুলের মতন মেয়েকে ছেড়ে এখানে আছো, তাতেই একটু অবাক হয়েছিলাম।

– আছি, সত্যি মেয়েটাকে ছেড়ে আছি। কঠিন পরিক্ষা দিচ্ছি।

-নোঙর কোথায় আছে?

– নোঙর ওর বাবা-ঠাকুমার কাছে আছে। আমার কাছে থাকার চেয়ে ওদের কাছে ভালো থাকবে।

– তুমি দেখতে যাও না?

– না। যাই না। আমার পরিবারে কেউ জানে না আমি এখানে আছি। আমি এখানে প্রতিটা বাচ্চার মুখের মধ্যে নোঙরকে দেখি, নোঙরের বড় হওয়াকে দেখি।

তাথৈয়ের চোখে জল চলে আসে। পরমা তাথৈকে জড়িয়ে ধরে। তাথৈয়ের মনে হয়, এই আলিঙ্গন কি ভীষণ ভরসার….

পরমা বলে চলে, দুপুর বেলা মাংস ভাত খেয়ে সে আমায় বলল তার ঘরে যেতে। ক’দিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম আমার প্রতি তার সদয় ভাবটা। সেদিন দুপুরে আমাকে সে অনেকদিন পর ভালবাসল, আমি তো জন্ম অভাগী, চাতুরতা বুঝি নি। শরীরের ক্ষিদে মিটিয়ে আমায় বলল বেড়াতে নিয়ে যাবে। নিজেই আলমারি থেকে একটা শিফন শাড়ি বের করে বলল, এটা পড়লে আমাকে নাকি তার খুব ভালো লাগে দেখতে। তার মনের মতন সেজে বেরোতে গিয়ে দেখলাম, গাড়ির বদলে সে বাইক বের করেছে। একবার বলেও ফেললাম, এই শাড়ি পড়ে বাইকে চড়লে পড়ে যাব তো! সে হেসে উড়িয়ে দিল। তারপর, প্রচণ্ড স্পীডে আঁকাবাঁকা ভাবে যেতে যেতে মনেই হচ্ছিল, এ যাত্রা আমার শেষ যাত্রা এবং পরিকল্পিত। গতজন্মে হয়তো কিছু ভালো কাজ করেছিলাম, তাই বেঁচে গেলাম। নোঙর হওয়ার পর শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়টাতেই ওকে কাছে পেতাম। তাই, সেই ঘটনার পর আর খুনির সাথে এক ছাদের তলায় থাকতে পারি নি।

তাথৈ মনে মনে ভাবছিল, আর কোনদিন সে দুঃখ করবে না তার অতীত নিয়ে। আর যাই হোক, ওর লড়াই পরমার কাছে কিছুই নয়।

তাথৈ পরমাকে বলে, দিদি, আমাকে তোমার সাথে রেখো।

পরমা বলে, আছি তো, আমরা এখন দুজনেই দুজনের সাথে থাকব, সবাইকে নিয়ে।

************************************************************

Jayati Mukherjee

Jayati Mukherjee

A born dreamer, in a strong relationship with myself, blessed with wonderful people in my life and in a way to transforming my wishes into reality.

More Posts

Follow Me:
FacebookLinkedInGoogle Plus

Related posts

2 Thoughts to “আশ্রয়”

  1. Avatar শ্রুতি বসু

    বেশ লাগলো লেখাগুলো

    1. Avatar WishScript

      Thank you. You can publish your writing too. Feel free to me at sujoyroyin@gmail.com

Leave a Comment